Tuesday, July 31, 2007

স্থানীয় সাংবাদিকতায় সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ তৃণমূল স্তরে সুশাসন ব্যাহত

সংবাদপত্রকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তৃণমূলে কতখানি গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে, গণতন্ত্র চর্চায় কি কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে জনগণ সরকার থেকে কি ধরণের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা ও তার সমাধান কি হতে পারে এ সকল কিছুই উঠে আসে স্থানীয় সংবাদপত্রে। মূলতঃ স্থানীয় সংবাদপত্র শাসক গোষ্ঠী ও জনগণের মাঝে মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কিšদ স্থানীয় সংবাদপত্র প্রকাশেও রয়েছে বিবিধ সমস্যা।বৈষম্যহীন সমাজ, সুষ্ঠু সমন্বিত উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সাংবাদিকতার প্রয়োজন অপরিহায্য। স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার বিকল্প ও সংবাদপত্র প্রকাশনায় গতিশীলতা বৃদ্ধি সুশাসন নিশ্চিত করার জন্যে অপরিহার্য।যে কোন ধরণের ধারণার চর্চা করতে হয় তৃণমূল থেকে। মফস্বলে অবস্থান করছে আমাদের তৃণমূল সমাজ। সুষম বন্টন ব্যবস্থায় কোন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া আমাদের দেশে গড়ে না উঠায় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী তৃণমূল সমাজ তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, সহকারি, বেসরকারি অসহযোগিতা, শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। চর্চা হচ্ছে না গণতন্ত্রের। অথচ দেশ এখন গণতান্ত্রিক শে¬াগানে মুখরিত। জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে সুশাসন থেকে।স্থানীয় সকল সমস্যা একমাত্র সংবাদপত্রই প্রকাশ করতে পারে। সংবাদপত্রকে মনে করা হয় জনগণের সদাজাগ্রত লোকসভা বলে। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের সুশাসন প্রাপ্তির অধিকার যেমন রয়েছে তেমনি সংবাদপত্র এ বিশাল জনবসতির সাথে মহামিলন ঘটিয়ে দিতে পারে। স্থানীয় সংবাদপত্র পারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে। সরেজমিন পরিদর্শন, সংশি¬ষ্টদের সাথে আলাপে জানা যায়, স্থানীয় সংবাদপত্রও এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ব্যর্থতার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: স্থানীয় পত্রিকার ডিক্লারেশনে সমস্যা, আর্থিক দৈন্যতা, বিজ্ঞাপন প্রাপ্তিতে সমস্যা, প্রশাসনের অসহযোগিতা, দক্ষ সংবাদকর্মীর অভাব, ব¯দনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের চাপ, ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে পত্রিকা প্রকাশ করা ইত্যাদি। সরকার ও সচেতন মহল স্থানীয় সংবাদপত্র প্রকাশে যথাযথ সহযোগিতার হাত বাড়ালেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে সকল মহলের ধারণা।
নোয়াখালীর সংবাদপত্র: নোয়াখালী জেলার সংবাদপত্রের ইতিহাসে দেখা যায়, স্থানীয় সংবাদপত্র জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠায় কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ১৮৭৪ সালে বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে থাকা অবস্থায় নোয়াখালী অঞ্চলের লোকজন ‘ঢাকা প্রকাশ’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও আর্থিক সহযোগিতা না পাবার কারণে সংবাদপত্রটি শেষ নাগাদ প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। নোয়াখালী থেকে প্রথম প্রকাশিত পত্রিকার নাম সাপ্তাহিক ‘পূর্ব বঙ্গবানী’। ১৮৮৮ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায় প্রকাশের মাত্র চার বছরের মাথায়।স্বাধীনতাপূর্ব বৃটিশ আমলে,পাকিস্তান শাসনামলে এ জেলায় প্রচুর সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর প্রায় সবগুলোই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৩০ বছরের মধ্যেও নোয়াখালীতে প্রচুর সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। কিšদ তার অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সংবাদপত্র প্রকাশনার ধারাক্রমটিকে মোট চার পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ বৃটিশ শাসনকাল- সংবাদপত্র বিকাশের সূচনাপর্ব। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তান শাসনামল পর্ব। তৃতীয়তঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তীকাল। চতুর্থতঃ নতুন জেলাভিত্তিক প্রশাসনিক বিন্যাস পরবর্তী।
ডিক্লারেশন: নজরানা যেন ফাইলের জীবনিশক্তি: জাতীয় পত্রিকাসমূহে স্থানীয় সংবাদ কম আসে বলে স্থানীয় জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরার জন্যে স্থানীয় পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। কিšদ স্থানীয় পত্রিকার ডিক্লারেশন পেতে অনেক খড়কাঠ পোহাতে হয়। এর জন্যে প্রথমে জেলা প্রশাসক বরাবরে দরখাস্ত করে ডিএফপি থেকে পত্রিকার নামে ছাড়পত্র আনতে হয়। এরপর ডিএসবি, এসপিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন টেবিল ঘুরে পত্রিকার ডিক্লারেশন ফাইল আলোর মুখ দেখে। কিšদ টেবিলে টেবিলে ফাইল চালনা করতেই সমস্যা হয় সবেচেয়ে বেশি। পত্রিকা ডিক্লারেশনের জন্যে বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ প্রদান করতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ হলে তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পত্রিকা প্রকাশনায় ইচ্ছে আছে, অর্থ নেই:ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টারের একদল কর্মীবাহিনী নোয়াখালীর বিভিন্ন সংবাদপত্র কার্যালয় পরিদর্শন করেন। পরিদর্শক দল পত্রিকার সম্পাদক, মালিক এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকার সম্পাদকের সাথে কথা বলেন। এ পরিদর্শনকালে যে তথ্যটি বেরিয়ে আসে তাহল, সকল পত্রিকার সম্পাদকদেরই পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছে আছে কিšদ তারা আর্থিক দৈন্যতার কারণে পত্রিকা প্রকাশ করতে পারছেনা। সরকারি বেসরকারি বিজ্ঞাপন না পাওয়ার কারণে অনেক পত্রিকাই বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়েকটি পত্রিকা এখনো টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশই সম্পাদকদের নিজ পকেটের টাকায় ছাপা হয় বলে জানান নোয়াখালী কন্ঠের সম্পাদক। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সংবাদকর্মীদের কোন সম্মানী দিতে পারে না ফলে সংবাদকর্মীরা এ পেশা ছেড়ে দিয়ে বিকল্প পেশায় চলে যায়। অবশ্য যথাযথ সম্মানীছাড়া যে কেন কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করাও ঠিক নয়। তাই জীবনের তাগিদে তারা অন্য পেশায় যুক্ত হয়। এতে করে স্থানীয় সংবাদগুলো প্রশিক্ষিত সংবাদকর্মী পায় না। পত্রিকা প্রকাশের জন্যে অর্থনৈতিক যোগান অবশ্যই দরকার সেজন্যে ডিএফপি কেন্দ্রীয়ভাবে বিজ্ঞাপন বন্টন বন্ধ করে স্থানীয়ভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত।
মালিক যিনি সম্পাদক-সংবাদকর্মীও তিনি: স্থানীয় পত্রিকাকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সচল রাখার জন্যে যে পরিমাণ দক্ষ লোকবল প্রয়োজন সেটি একেবারে নেই বললেই চলে। নোয়াখালী থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ পত্রিকার সাথে যুক্ত রয়েছে কিছু তরুন। যারা সাংবাদিকতার দায়িত্ব ও লেখালেখির দক্ষতা সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই রাখেন না। কোনরূপ প্রশিক্ষণ ছাড়া একসময় এ রকম লিখতেন মোঃ হারুনুর রশিদ বলেন, সমাজের নানা ধরণের মানুষের সাথে বাস করতে গিয়ে যে ঘটনাটি আমার কাছে অ-স্বাভাবিক মনে হতো সাধারণতঃ সেই ঘটনা দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতাম। তাছাড়া সংবাদ লেখার আলাদা কাঠামো আছে, লেখার কৌশল আছে এ ধরণের কোন ধারণাও রাখতাম না। সাংবাদিকতার মাধ্যমে যে একটি মহৎ কাজ সম্পন্ন হয় সে কথা আজকে অনেকেই বিশ্বাসই করে না। প্রত্যেকে এ সকল কাজকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখে। চৌমূহনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পূর্বশিখার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম হারুন বলেন, কিছু আগ্রহী তরুন খুব আগ্রহ নিয়ে মাঝে মধ্যে লেখালেখি শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত আমরা আর্থিক দৈন্যতার কারণে তাদেরকে যথাযথ সম্মানী দিতে পারিনা বলে পরবর্তীতে তারা অন্য যে কোন পেশায় চলে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক বলেন, স্থানীয় পত্রিকাগুলো সাধারণত দু’একজনের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় নামকা ওয়াস্তে দু’একজনের নাম ব্যবহারই হয় মাত্র। কার্যত একজন ছাড়া বাকী কেহ প্রকাশনায় যুক্তও থাকেনা। এতে সম্পাদক যিনি সংবাদকর্মীই তিনি। আবার সংবাদকর্মী যিনি মালিকও তিনি।
স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, অযথা খরচ: পত্রিকা প্রকাশের জন্যে প্রয়োজন আর্থিক সঙ্গতি। আর এ আর্থিক স্বচ্ছলতার একটি উপায় সরকারি ও বেসরকারি বিজ্ঞাপন। কিšদ স্থানীয় পত্রিকার জন্যে প্রচলিত বিজ্ঞাপন নীতি রয়েছে তা খুবই বৈষম্যমূলক। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও রয়েছে সমস্যা। স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ শিল্প কারখানা না থাকার কারণে বেসরকারি অবস্থান থেকেও তেমন কোন বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে নোয়াখালী কন্ঠ সম্পাদক আফতাব উদ্দিন বাচ্চু বলেন, বেসরকারিভাবে যাদের দুএকটি কল কারখানা আছে তারা মনে করে স্থানীয় পত্রিকার পাঠক কম। কম মানুষই স্থানীয় সংবাদপত্র পড়ে। তাই স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলে তাদের প্রচার-প্রসার কম হবে ভেবে তারা জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রদানকে তারা অযথা খরচ বলে মনে করেন। সাপ্তাহিক ফয়সালা পত্রিকার সম্পাদক আবু জাফর বলেন, ‘সরকারি পর্যায় থেকে স্থানীয় পত্রিকাগুলো যে ছিঁটেফোটা বিজ্ঞাপন পায় তাতে তেমন একটা সাশ্রয় হয় না।’ সরকারি দুএকটি বিজ্ঞাপন পাওয়া গেলেও বিজ্ঞাপনের বিল প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় পত্রিকাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হলে স্থানীয় বিজ্ঞাপনগুলো স্থানীয় পত্রিকায় দেওয়া উচিত। স্থানীয় পত্রিকার সাথে যেহেতু আম জনতার জীবন জীবিকার যোগসূত্র থাকে তাই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানটির সাথে জনতার মিলন অটুট রাখার জন্যে স্থানীয় সংবাদপত্রও অত্যাবশ্যক।অমুক ভাইয়ের সংবাদ ছাপা যাবেনা: সাংবাদিকরা অনেক সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও প্রশাসনিক দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ ছাপার ফলে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল প্রশাসন কর্তৃক হুমকির সম্মুখীন হতে হয়। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে এমন অনেক ঘটনা আছে বলে বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপকালে জানা যায়।ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির কথা পত্রিকায় প্রকাশ করায় স্থানীয় সাংবাদিকরা নোয়াখালী কোম্পানীগঞ্জ থানার বসুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান আঃ কাদের মীর্জার রোষানলে পড়তে হয়। তিনি জনসম্মুখে সাংবাদিকদের গালিগালাজ করেন। এমনকি তার দুর্নীতির বিষয়ে লেখার ফলে অনেক সাংবাদিককে এলাকা ছেড়ে ফেরারী জীবন যাপন করতে হয়। এছাড়াও ফেনীতে সত্য ও ব¯দনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করার অপরাধে সাংবাদিকদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি এ সকল গোষ্ঠীর চাপে কয়েকটি স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়। একই ঘটনা ঘটে লক্ষ্মীপুরে। সেখানে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান বিভিন্ন দুর্নীতি, অন্যায়, নির্যাতন, খুন ইত্যাদির কথা স্থানীয় সাংবাদিকরা পত্রিকায় তুলে ধরলে তিনি তৎকালীন একজন মন্ত্রীর সামনে জনসম্মুখে সাংবাদিকদের হাত-পা কেটে ফেলার হুমকি দেন। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক আফতাব উদ্দিন বাচ্চু বলেন, স্থানীয় পত্রিকার কোন সংবাদ ছাপাতে হলে স্থানীয় গড ফাদারদের অনুমতি নিতে হয়। কোন সংবাদটি ছাপানো যাবে কোনটি যাবে না তা স্থানীয় টাউটরা সম্পাদকদের পরামর্শ দেন। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এ সকল কথা উপেক্ষা করার কারণে একটি রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা তার পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে। হুমকি, ভীতি, রাজনৈতিক চাপ ইত্যাদি কারণে জাতীয় ও স্থানীয় পত্র পত্রিকায় গ্রামের খবর প্রবাহের হারও খুবই নগন্য।
প্রশাসন ভাবে সাংবাদিক নয় যেন গোয়েন্দা: সাংবাদিকরা স্থানীয় প্রশাসনের যথাযথ সহযোগিতা পায় না। প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ডাকার নিয়ম থাকলেও তাদের তেমন একটা ডাকা হয় না। আবার অনেক সময় প্রশাসন কেবল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনকারী সাংবাদিকদের ডাকে। এছাড়াও সাংবাদিকরা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনরূপ তথ্য চাইলেও তারা দিতে চায়না। সাংবাদিকদের কোন প্রকার তথ্য প্রদান করা হলে তাদের বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ফাঁস হয়ে যাবে এ ধারণা থেকে তারা কোন তথ্য দেয় না। এছাড়াও প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়মের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ করার অভিযোগে অনেক সাংবাদিককে অতীতে মামলা ও গ্রেফতার বরণ করতে হয়েছে। প্রশাসনে যে কোন তথ্যের জন্যে গেলে তাদের সোজা কথা উপরস্থ অনুমতি ছাড়া দেওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে সমাজকর্মী মামুনুর রশিদ বলেন, সাংবাদিকরা প্রশাসন ও জনগণের মাঝে মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে এবং প্রশাসনের তাই মনে রাখা উচিত। কিšদ তারা সাংবাদিকদের সাংবাদিক মনে না করে গোয়েন্দা মনে করে। এতে করে জনজীবনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেকাংশে ব্যাহত হয়।
সাংবাদিকের প্রশিক্ষণ যেন মালিকের অপচয়: সারাদেশে সাংবাদিকের সংখ্যার তুলনায় দক্ষ সাংবাদিকের পরিমাণ অত্যন্ত কম। স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরা দক্ষতা উন্নয়নের জন্যে তেমন কোন প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় না। আর এই অদক্ষতা জন্যেই স্থানীয় সাংবাদিকরা সংবাদমূল্য নির্ধারণে অনেকাংশে ব্যর্থ হন। ফলে সংবাদ হওয়ার মত সংবাদও যথাযথভাবে উপস্থাপন হয় না। দৈনিক মাতৃভূমি নোয়াখালী জেলা প্রতিনিধি মিরন মহিউদ্দিন জানান, তৃণমূল পর্যায়ে প্রাত্যহিক জীবনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, উন্নয়ন বিষয়ক হাজারো ঘটনা ঘটছে। আবার অনেক সুপ্ত ঘটনাই আছে যেগুলোর সাথে বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংশি¬ষ্ট। কিšদ প্রশিক্ষিণের অভাবে বর্তমানে অনেক সংবাদকর্মীই সে সকল ঘটনাকে এড়িয়ে চটক সংবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে।সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সাংবাদিকতার রয়েছে বিশাল ভূমিকা। এমন ঘটনাই আছে যেগুলো সংবাদপত্রে প্রকাশের পর জনগণ তার প্রতিকার পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রশিক্ষিত একজন সংবাদকর্মী বলেন, নোয়াখালীর স্থানীয় সংবাদপত্র লোক সংবাদ কোম্পানীগঞ্জে চর দখলকারীরা ৯টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, রায়পুরে মাছ ঘাট, বয়ারচরের উপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদকমূলক সংবাদ প্রকাশের পর সংশি¬ষ্ট সাধারণ মহল এ বিষয়ে প্রতিকার পেয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষও তাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছে। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সংবাদের রয়েছে শক্তিশালী অবদান। কিšদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের অভাবে স্থানীয় সংবাদ পত্র-পত্রিকায় কর্মরত সংবাদকর্মীদের মধ্যে জনগণ, সংবাদপত্র ও প্রশাসনের সাথে সম্পর্কের প্রকৃতি যেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কিত ধারণার অভাব রয়েছে। সেই সাথে সমাজের সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতার অভাবে সংবাদপত্রগুলো স্থানীয় জনতার দুঃখ দুর্দশা ও চাওয়া পাওয়ার মুখপাত্র হয়ে উঠছে না। জনগণও সে কারণে স্থানীয় সংবাদপত্রের মুখাপেক্ষী হয়ে উঠছে না।স্থানীয় কিছু উৎসাহী যুবক সাংবাদিক পরিচয়ে আনন্দবোধ করে বলে তারা স্থানীয় পত্রিকাদির সাথে জড়িত থাকে। কিšদ তাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। ফলে সংবাদপত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উঠে আসে না। যদি সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণ থাকতো এ সমস্যা হতো না। এ সমস্যা সমাধানের জন্যে পিআইবিসহ দু’একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মাঝে মধ্যে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের জন্যে প্রশিক্ষণের আয়োজন করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ ধরণের প্রশিক্ষণের জন্যে যে পরিমাণ অর্থ দরকার তা স্থানীয় অনেক পত্রিকারই নেই। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠান পত্রিকার অর্থ যোগান দেবার সুযোগ থাকলেও স্থানীয় সংবাদকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশ্নে তারা অনীহা দেখায়। এ প্রসঙ্গে নোয়াখালীতে কর্মরত একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদক বলেন, সংবাদকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে অর্থ খরচ করাকে মালিকপক্ষ অহেতুক অপচয় বলে মনে করে।
পত্রিকা নয় যেন তোষামোদনামা: সংবাদপত্রকে জনমানুষের মহামিলন কেন্দ্র বলা হলেও কিছু কিছু স্থানীয় সংবাদপত্র মাঝে মাঝে শিল্পপতির বায়না বা তোষামোদ করে প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক মিরণ মহিউদ্দিন বলেন, আসলে এজন্যে আর্থিক দৈন্যতাই দায়ী। অর্থাভাবে সম্পাদক পত্রিকা প্রকাশ করতে অপারগ হলে কোন বিশেষ ব্যক্তির দ্বারস্থ হন। আর সে ব্যক্তির নিকট থেকে কোন প্রকার সাহায্য পেল তার পক্ষে হয়ত দু’এক কলম লিখে। যদিও তা মোটেই ঠিক নয়। মাঝে মাঝে দেখা স্থানীয় পত্রিকাগুলোর কোন কোনটি সংবাদপত্রের আদ্যোপ্রান্তে একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার, জীবন বৃত্তান্তসহ কেবল একজন মানুষকে নিয়ে লিখে থাকে। এ ক্ষেত্রে পত্রিকাটি কিšদ উক্ত ব্যক্তির বিজ্ঞাপনপত্রে পরিণত হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক বলেন, আসলে কিছু কিছু সম্পাদক আছেন তারা পত্রিকার নাম ভাঙিয়ে শিল্পপতিদের কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে একটি সংখ্যা বের করে উক্ত ব্যক্তির খানিকটা তোষামোদ করে। আর বাকী টাকা দিয়ে নিজের উদর পূজা করে। এতে করে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হন। এ সকল কাজগুলো যে কোন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের বা সময়ের আগে ঘটে থাকে বলে সাধারণ মানুষ সে ব্যক্তির ইতিবাচক নেতিবাচক কোন খবরাদি না জেনে উক্ত ব্যক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ফলে জনসাধারণ নেতা নির্বাচনের সময়ও শঠতার শিকার হন। নগর বার্তা বনাম পল¬ী বার্তা>বিপাকে পাঠক: রাজধানী থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো নানা রঙে প্রকাশিত হয় বলে পত্রিকাগুলোর প্রতি পাঠকের আগ্রহ থাকে খুব বেশি। স্থানীয় পত্রিকাগুলো লেটার প্রেসে হালকা ও ঝাপসা অক্ষরে ছাপা হয় বলে পাঠক পত্রিকার প্রতি তেমন আগ্রহী হয়ে উঠে না। গ্রামের একজন সাধারণ পত্রিকা পাঠক কামাল উদ্দিন বলেন, স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে সাধারণত কিছু হার্ড নিউজ থাকে। এছাড়া পাঠকের জন্যে আলাদা কোন বিভাগ থাকে না। কিšদ ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন বিভাগ থাকে বলে তারা বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারে। তাছাড়া স্থানীয় পত্রিকাগুলো মাঝে মাঝে জাতীয় পত্রিকাগুলোর নিউজ, প্রবন্ধ, কলাম পুনরায় ছাপিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেন। স্থানীয় পত্রিকাগুলোর অন্যতম একটি পাঠক স্বল্পতা। স্থানীয় পত্রিকা বৈশিষ্ট্য ও গুণ ঠিকমত থাকে না বলে এ সমস্যা। পত্রিকা পাঠক কামাল উদ্দিন আরো বলেন, অনেকে শহরের চটক খবর পাঠে বেশি আগ্রহী। তারা সাধারণত খুটিয়ে খুটিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ে। স্থানীয় সংবাদ সম্পর্কে তারা জানতে চাইলে জানতে পারে কম। কেননা জাতীয় পত্রিকাগুলোতে মফস্বলের জন্যে মাত্র ২/১টি পাতা বরাদ্দ থাকে। তাতে ৬৮ হাজার গ্রামের ছবি ভেসে উঠে না। বাংলাদেশ প্রেস ইনিষ্টিটিউটের সাময়িকী নিরীক্ষা’য় (৫৮তম সংখ্যা ১৯৯২) প্রকাশিত রচনায় গবেষক সীমা মোসলেমের তথ্য মোতাবেক ঢাকা থেকে প্রকাশিত পাঁচটি জাতীয় দৈনিকে আট দিনের সংবাদ অংশের মধ্যে মফস্বল সংবাদে অংশ দৈনিক সংবাদ ৩৮.৯৮%. দৈনিক ইত্তেফাক ২০.৮৮%, দৈনিক ইনকিলাব ১৯.১৯%, দৈনিক বাংলা ১৭.৮৭%, বাংলাদেশ অবজারভাব ১২.৬১%। অথচ গ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ। কিšদ জাতীয় পত্রিকায় গ্রামের জন্যে বা স্থানীয় খবরের জন্যে জায়গা খুব কম। গ্রামের পাঠক যেমন শহরের সংবাদের অন্বেষণ করে তেমনি শহরের পাঠক ও গ্রামের সংবাদের খোঁজে থাকে। কিšদ সংবাদ প্রকাশের যথাযথ উপায় না থাকায় দু শ্রেণীর পাঠকই হতাশ হন। স্থানীয় সংবাদপত্রের এ শূন্যতা সম্পর্কে সাপ্তাহিক ফয়সালার সম্পাদক বলেন, মফস্বলে রয়েছে প্রযুক্তিগত সমস্যা। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো ছাপা হয় লেটার প্রেসে। এখানে আধুনিক অফসেট প্রেসও প্রযুক্তির রয়েছে অভাব। হাতিয়ায় নেই কোন প্রেস। ফলে সেখানকারপত্রিকাগুলো জেলা শহর থেকে সম্পাদকগণছাপিয়ে নিয়ে যান। পত্রিকা গুণগত মান ও বৈশিষ্ট্য ঠিক করা সম্ভব হলে স্বল্প পাঠক সমস্যা যেমন দূর হবে তেমনি পাঠককেও গ্রামের খবর শহরের খবর খুঁজতে হবে না। মান সম্মত পত্রিকা প্রকাশ হলেই মানুষের কেন্দ্রানুগ মানসিকতা লোপ পাবে। সম্পাদক ও সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা । পত্রিকার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করে স্থানীয় সমস্যা ও সমাধানের প্রতিবেদন উপস্থাপন সহ প্রশাসনিক যাবতীয় সহযোগিতা প্রদান করা দরকার। এছাড়া ডিএফপি বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপননীতি বদল করা যেতে পারে। স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্যে বিজ্ঞাপন দাতাদের উৎসাহীত করার দরকার। ১০ বছর পূর্বে প্রকাশিত পত্রিকা ডিএফপি অডিট গ্র“ফের আওতা থেকে মুক্ত করা যেতে পারে।

1 comment:

asadjewel said...

মাসুদ ভাই
লেখাটা ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ
আপনার ইমেইল আইডি টা জানালে কৃতার্থ হব।
আমার আইডি
asadjewel@gmail.com
www.asadjewel.blogspot.com