Saturday, July 28, 2007

ভূমি সংস্কার নীতি বাস্তবায়নে শম্ভুক গতি

ভূমি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের ক্ষেত্রে দ্বৈত শাসন, অব্যবস্থা ও সমন্বয়হীনতা, মান্ধতার নিয়মে রেকর্ড সংরক্ষণ ও সংশোধন পদ্ধতির ফলে ভূমি সংস্কার নীতি বাস্তাবায়িত হচ্ছে না। গ্রামীণ উন্নয়নকে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু ধরে দারিদ্র্য পীড়িত কৃষি নির্ভর আমাদের দেশের ভূমি সংস্কারের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা ছাড়া দেশের অর্থনীতির আমুল পরিবর্তন সম্ভব নয়।
ভূমি সংস্কার কি? : অর্থনীতিবিদদের মতে ভূমি সংস্কার হচ্ছে ভূমি ব্যবস্থার ত্র“টি সমূহ দূর করে জমির মালিকানা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে ভূমির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের পুরোপুরি স্বার্থ সংরক্ষণ ও দেশের সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নের জন্যে যথাপোযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ভূমির মালিকানার পূণবিন্যাস, মালিক ও প্রজার মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন, জমির খন্ডীকরণ রোধ, খন্ডিত জমিসমূহ একত্রীকরণ এবং কৃষির সাথে যুক্ত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রভৃতি বিষয়গুলোকে ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মূলত এক কথায় বলা যেতে পারে ভূমি সংস্কার হচ্ছে, বিদ্যমান ভূমিস্বত্বের ত্র“টিসমূহ দূর করে দেশের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে যে যথাপোযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাই ভূমি সংস্কার।
ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা: আমাদের মত একটি কৃষি নির্ভর উন্নয়নশীল দেশের জন্যে ভূমি সংস্কার উন্নয়নের পথে একটি মৌলিক বিষয়। কেননা দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং সকলেই কোন না কোনভাবে গ্রাম অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত এবং নির্ভরশীল। নরোত্তমপুর ইউনিয়ন কৃষি ব্লক সুপারভাইজার আব্দুল মতিন বলেন, আমরা ভূমি নির্ভর দেশের মানুষ। যেহেতু গ্রাম অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ভূমি নির্ভর তাই আমরা সকলেই ভূমি নির্ভর। গ্রামীণ মানুষের অধিকাংশ ইতিমধ্যে জমি হারিয়ে ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণ জনসংখ্যার ৬২ শতাংশই এখন ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আর্থ-সামাজিক কাঠামো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অব্যবস্থার কারণে প্রতি বছর এ সংখ্যা আরো বেড়েই চলেছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৪০ আসে কৃষি থেকে তথা ভূমি থেকে। তাছাড়া মোট শ্রম শক্তির ৭২ ভাগই কৃষি উৎপাদন তথা ভূমিতে নিয়োজিত। তাই এ সকল বৈষম্য ও দারিদ্র্যতার চিত্র পরিবর্তন করতে হলে ভূমি সংস্কার করা অত্যাবশ্যক বলে আবদুল মতিন জানান।
ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যে সকল লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে: অর্থনীতিবিদের অভিমত, প্রান্তিক কৃষক, সাধারণ মানুষ ও পেশাজীবিদের সাথে আলাপ করে ভূমি সংস্কার যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ভিতর দিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যগুলো অর্জিত হতে পারে বলে জানা যায় সেগুলো হলো: ১। কৃষি উৎপাদন ও জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ২্। ভূমির যথাযথ ব্যবহার এবং স্থায়ী ব্যবহার যোগ্যতার নিশ্চয়তা সৃষ্টি ৩। ভূমি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সম্পদ খাল, বিল,জলাশয়, জনমহল, পুকুর ইত্যাদি সুষ্ঠু ব্যবহারের নিশ্চয়তা সৃষ্টি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। ৪। ভূমিহীন (সব ভূমিহীন পরিবারকে ভূমি দেওয়া সম্ভব নাও হয়) প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের হাতে চলে আসা জমি ও সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি, ফলে তাদের উৎসাহ, উদ্যোগ দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পরিণামে উৎপাদন বৃদ্ধি। ৫। প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং অন্যান্য সুবিধা প্রান্তিক ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষকদের নাগালের মধ্যে আসা যার ফলশ্র“তিতে তাদের উদ্বুদ্ধ ও সঞ্চয় বৃদ্ধি। ৬। এ সকল উদ্ধুত্ত ও সঞ্চয় অকৃষিজ নানা উৎপাদনশীল উদ্যোগ ও গ্রাম ভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগের বাস্তব সম্ভাবনা তৈরী। ৭। গ্রামীণ দরিদ্র বেকারদের কর্মসংস্থান/আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ৮। গ্রামীণ দরিদ্রদের ব্যাপকাংশের জীবনমান উন্নয়ন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া রোধ।
ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যে সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক সুফল অর্জিত হতে পারে: (ক) সমাজে ভূমিকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে যে সব হানাহানি মারামারি, মামলা-মোকদ্দমা, খুনাখুনি ঘটে আসছে তা হ্রাস পাবে এবং পরিণামে ভূক্তভোগীদের অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ অপচয় থেকে রক্ষা পাবে। (খ) বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর যে চরম ভারসাম্যহীনতা ও বৈষম্য রয়েছে তা হ্রাস প্রাপ্তি ও স্থানীয় উন্নয়মূলক প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগের সাথে ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ কর্মকান্ডে সমষ্টিগতভাবে অংশগ্রহণের ফলে বৃহত্তর জনগোষ্টীর সংহতি চেতনা বৃদ্ধি, সমষ্টিগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উন্নয়নে তার ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি। (ঘ) উৎপাদনমুখী ও সামাজিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং এপথে বিদ্যমান সামাজিক বাধাগুলো দ্রুত বিলুপ্তি। (ঙ) ভূমি সংস্কারের বাস্তবায়নে স্থানীয় স্বশাসিত সরকারের সম্পৃক্ত করার ভিতর দিয়ে স্বশাসিত সরকার কাঠামো আরও গতিশীল, অংশগ্রহণমূলক ও জনগণের কাছে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিতামূলক হয়ে উঠবে। (চ) ভূমি একটি বহুমাত্রিক কর্ম। তাই এর বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ সামাজিক ফলাফল হিসাবে উৎপাদনে ব্যাপক গণউদ্যোগ সৃষ্টি, গণশিক্ষায় নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, সামাজিক পরিবেশ, গণস্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, রোগ ও মহামারী প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি। (ছ) গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্টীর ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে তা ব্যাপক শিল্পায়নের সহায়ক হবে।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ভূমি সংস্কার: ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর থেকে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যবস্থা গৃহিত হয়েছিল। এতে কৃষি উন্নয়নের পথ কিছুটা হলেও প্রশস্ত হয়েছিল। কিšদ কৃষির উন্নয়নে যে বিপ্লব গঠিত হওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল তা প্রকৃতপক্ষে হয়নি। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ সরকার কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এ লক্ষ্যে ১৯৭২ ভূমি সংস্কার। ১৯৭২ সালের ভূমি সংস্কার নীতির বিশেষ দিক সমূহ হলো: ১। খাজনা মওকুফ: দরিদ্র কৃষকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকার ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সকল বকেয়া খাজনা সুদসহ মওকুফ করে দিয়েছেন। ঐ একই দিন হতে ২৫ বিঘার কম জমির খাজনা মওকুফ করে দেওয়া হয়। ২। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ: সরকার জমির সর্বোচ্চ মালিকানা পরিবার প্রতি ১০০ বিঘায় নির্দিষ্ট করে দেন। তবে ফলের বাগান, চা বাগান ও ডেইরী ফার্মের ক্ষেত্রে জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা শিথিলযোগ্য থাকবে।৩। জমি বন্টন: নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ সীমার অধিক উদ্বুদ্ধ জমি ভূমিহীন কৃষক, নদী ভাঙনে ছিন্নমূল ও প্রান্তিক কৃষকদের (যাদের ১.৫ একরের কম জমি রয়েছে) মধ্যে বন্টনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।৪। ইজারাদারী প্রথার বিলোপ: দীর্ঘকাল যাবৎ বাংলাদেশে নির্যাতনমূলক ইজারাদারী প্রথা প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশ সরকার এ প্রথার বিলোপ সাধন করেন।৫। অনাবাদী জমি চাষের বিশেষ কর্মসূচি: অনাবাদী জমি চাষের জন্যে সরকার এ নীতিমালার এক বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।৬। পৃথক মন্ত্রণালয় স্থাপন: দেশের ভূমি স্বত্ত্ব ব্যবহার দ্রুত সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে সরকার ‘ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার’ নামক একটি পৃথক মন্ত্রণালয় স্থাপন করেছেন।১৯৮২ সালর জুলাই মাসে ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি ভূমি সংস্কার কমিটি গঠন হয়। এ কমিটি ১৯৮৩ সালের জানুয়ারী মাসে ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরকারের নিকট বিভিন্ন সুপারিশ পেশ করেন। এ সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্যে সরকার ভূমি সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ১৯৮৪ জারি করেন। এ ভূমি সংস্কার নীতি ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার নীতি নামে পরিচিত। ১৯৮০ সালের ভূমি সংস্কার নীতির উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিুরূপ: ১। পরিবার প্রতি জমি সর্বোচ্চ মালিকানা ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবং তা কোন অবস্থাতেই পরিবর্তন করা হবেনা। ২। যাদের জমি বর্তমানে ৬ বিঘার নীচে রয়েছে ক্রয়ের মাধ্যমে তা ৬০ বিঘার উর্ধ্বে নেওয়া যাবেনা। ৩। বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত এরূপ জমি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা যাবেনা। বসতবাড়ি নির্মাণ করার মত খাসজমি থাকলে সরকার বা ভূমিহীন ও শ্রমিকদের মধ্যে বন্টন করবেন। ৪। বিনা চুক্তিতে কেউ অন্যের জমি চাষ করতে পারবেনা। বর্গাচুক্তি ৫ বছরের জন্যে স্থায়ী হবে। ৫। কোন বর্গাকার ১৫ বিঘার অধিক জমি বর্গা শর্তে রাখতে পারবেনা। ৬। মালিক বর্গায় প্রদত্ত জমি বিক্রি করতে চাইলে তা ক্রয়ের প্রথম সুযোগ বর্গাদারকে দিতে হবে। ৭। বর্গায় প্রদত্ত জমির উৎপাদিত ফসল তেভাগা নীতিতে বন্টন করতে হবে। অর্থাৎ উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশ মালিক, এক তৃতীয়াংশ বর্গাদার ও এক তৃতীয়াংশ মালিক বর্গাদার উৎপাদনের উপাদানের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে পাবে। ৮। কৃষি মজুরদের ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩.৫ সের (৩.২৭ কেজি) চাল। ৯। জমির মালিক ও বর্গাচাষী যে ক্ষেত্রে সমভাবে সকল কৃষি উপকরণ সরবরাহ করবে সেক্ষেত্রে ফসল ৫০:৫০ হিসেবে মালিক ও বর্গা চাষীর মধ্যে বন্টিত হবে। ১০। নতুন চর এলাকায় পাওনাযোগ্য জমি ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের মাঝে বন্টনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১১। গ্রামীণ এলাকায় উৎপাদন ও সংগঠন কাঠামোকে ন্যায়ধর্মী করে তোলার উদ্দেশ্য সামনে রেখে খাস কৃষি জমি কেবলমাত্র ভূমিহীন বা প্রায় ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্দোবস্ত দেওয়া যেতে পারে। ১২। গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী কৃষকদের ঋণের দায়ে বা¯দভিটা থেকে উচ্ছেদ করা যাবেনা।্এছাড়াও ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ৫০০০/- টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ সুদসহ এবং ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফ করেন। ভূমি সংস্কার নীতি এ যাবতকাল পর্যন্ত যেভাবে গৃহিত হয়েছে তাতে গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসনের পথ প্রশস্ত হয়নি। প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষুদ্র কৃষকে এখনও ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে। নানাভাবে হচ্ছে নিগৃহীত।
সরকার গৃহিত ভূমি সংস্কারের ফলাফল: বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সাল এবং ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন তা কতটুকু কার্যকরী হয়েছে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের জেলা যুগ্ন আহবায়ক আবদুল মমিন বিএসসি বলেন, জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করা হলেও উদ্বুত্ত জমি সরকারের হাতে আসেনি। তাছাড়া ভূমি বন্টনের ক্ষেত্রে এখন নাগাদ কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে ভূমিহীনদের সংখ্যা না কমে ক্রমশঃ বেড়েই চলছে। তাছাড়া সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করলেও শিক্ষা কর, সেচকর ইত্যাদি কর মওকুফ করেনি। ফলে কৃষকরা লাভবান হতে পারেননি। এগুলো নীতিমালার ব্যর্থতা হলেও পাশাপাশি কিছু সফলতা আছে বলেও তিনি জানান, বর্গাদারের স্বার্থ সম্পর্কে তিনি বলেন, উৎপাদিত ফসল কিভাবে মালিক ও বর্গাদারদের মধ্যে বন্টিত হবে সে বিষয়টি নির্ধারণ হওয়ায় সে সমাধান হয়েছে। ন্যুনতম কৃষি মজুরিও নির্ধারণ হয়েছে। তবুও যে সকল লক্ষ্য সামনে রেখে ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্য তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বলেও তিনি জানান।
ভূমি সংস্কার নীতি ও বর্তমান অবস্থা: স্বাধীনতা লাভের পরে দুইটি ভূমি সংস্কার নীতিমালা প্রণয়ন হলেও সাধারণ কৃষকদের তথা ক্ষুদ্র প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে তা পুরোপুরি সহায়ক হতে পারেনি বলে অনেকে মন্তব্য করে। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে বাটইয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শেখ আহম্মদ ভূঞা বলেন, জমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা ১০০ বিঘা নির্ধারণ এবং পরবর্তীকালে তা কমিয়ে জমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা ৬০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়। জমির সর্বোচ্চ সীমা এভাবে নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিরাজমান ধনবৈষম্য হ্রাস পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়নি। জমির সর্বোচ্চ সীমা ২৫ বিঘা থেকে ৪০ বিঘার মধ্যে ধার্য করলে গ্রামাঞ্চলে ধনবৈষম্য হ্রাস পেত এবং সাধারণ কৃষকদের অবস্থার উন্নতি হতো। ভূমি সংস্কার পদক্ষেপে উদ্বুত্ত জমি ক্ষুদ্র প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিšদ জমির সর্বোচ্চ মালিকানা ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করায় বন্টন করার মত পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত জমি সরকারের হাতে আসা সম্ভব নয়। ১০০ বিঘা জমি পরিবার প্রতি রাখার পর মাত্র ১২ লক্ষ একর উদ্বৃত্ত জমি সরকারের হাতে আসবে। সরকারের হাতে রয়েছে ৪ লক্ষ একর খাস জমি। বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ১৪ লক্ষ। মাথাপিছু অর্ধ একর জমির রয়েছে এমন কৃষকের সংখ্যা ১৬ লক্ষ। এ সকল কৃষকও মূলত ভূমিহীন। মাত্র ১৬ লক্ষ একর জমি ৩০ লক্ষ কৃষকের মধ্যে বন্টন করলে প্রত্যেকে অর্ধ একরের মত জমি পাবে। এমতাবস্থায় কৃষকদের প্রকৃত অবস্থার মৌলিক কোন পরিবর্তন না হওয়াই স্বাভাবিক।এক জরিপ থেকে দেখা যায় যে, মোট আবাদী জমির শতকরা ২৫ ভাগ মাত্র ২ শতাংশ লোকের মালিকানায় রয়েছে। পক্ষান্তরে শতকরা মাত্র ৪.৮ ভাগ জমি রয়েছে ৫০ ভাগ চাষীর মালিকানায়। বর্তমানে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৬০জন। গ্রামীণ এলাকার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা অভাবের তাড়নায় তাদের শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে। আর মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ভূমি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
ভূমি সংস্কারের বাস্তবতা: আমাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম। তাই সংগতিপূর্ণ সংস্কার করতে হলে দেশের সিলিং অনেক নীচে নামাতে হবে। ফলে ধনী এমনটি মধ্যম শ্রেণীর কৃষকদের একটি অংশ ও সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। তবুও যে জমি পাওয়া যাবে তা দেশের বিপুল গ্রামীণ জনগণের প্রত্যেকের মাঝে দেওয়াও অসম্ভব হয়ে উঠবে। তবুও যদি তা দেওয়া হয় তাতে অনেক অ-অর্থনৈতিক ক্ষুদ্রজোতের জন্ম হবে। আর যদি ভূমিহীনদের নয় কেবল যাদের জমি আছে তাদের দেওয়া হয় তাহলে গ্রামের ভূমিহীনরা সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের অভিমত হল, ভূমি সংস্কারের মূলভিত্তি হচ্ছে ‘গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতা কাঠামোকে ভেঙ্গে সেখানে একটি সমতা বিমুখী প্রবৃদ্ধির সুচনা ঘটানো।’
ভূমি সংস্কারের জন্যে যা করা যেতে পারে: রেকর্ড সংরক্ষণ ও সশোধন পদ্ধতির ভুলের জন্যে মালিকানা নিয়ে জটিলতা একাধিক দাবীদারের জন্ম এবং জালিয়াতির ও প্রতারণার সুযোগ রয়েছে। রেকর্ড সংরক্ষণ ও সংশোধন পদ্ধতির আধুনিকীকরণ ও উল্লেখিত অবস্থা ও সমন্বয়হীনতা দূর করা ভূমি প্রশাসন সংস্কারের একটি মৌলিক ও জরুরী করণীয় বলে গণ্য করা উচিত। আর এস রেকর্ডের বিষয়টি একটি চালমান প্রক্রিয়া। তবুও এ প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান ত্র“টি ও জটিলতার জন্যে জনগণের কষ্টের অন্ত নেই। তাই সিএস এবং এস এ রেকর্ডের তথ্যাদি ম্যাপ পর্চা এসকল বিষয়গুলো সংরক্ষনে আধুনিকায়ন করা উচিত বলে তিনি জানান। ভূমি আইনের সংস্কার ভূমি সংস্কারের মৌলিক লক্ষ্যে পৌছার জন্যে অত্যাবশ্যক। বর্তমান আইনগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে এ আইনটি পর্যালোচনা করা উচিত। তাতে এ আইনটি থেকে প্রয়োজনীয় অংশ বাতিল করে সমযোপযোগী করা উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির স্বার্থেই অপরিহার্য।ভূমি সংস্কারের বড় কাজগুলোর মধ্যে আরো ভাবনার যা তা হচ্ছে ভূমি নিয়ে বিচার পদ্ধতির কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার। খাস জমি, চরের জমি, বন, জলা, বিল, জলমহল, জাল দলিলের ভিত্তিতে রুজু করা টাইটেল সুট-এ জাতীয় মামলা যার সঙ্গে অনেক মানুষের ভাগ্য ও স্বার্থ জড়িত। তা দ্রুত নিষ্পতির জন্যে ভূমি ট্রাইবুনাল গঠন করা যেতে পারে।১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশে বর্গাচাষীদের অধিকার সংরক্ষণের কিছু বিধান চালু আছে। তবুও এ নিয়ম বাস্তবায়নে কিছু জটিলতা আছে। এ জটিলতা দূর করে আইনটিকে বাস্তবায়ন যোগ্য করা উচিত বলে অনেকেই মতামত দেন। বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির শতকরা কতভাগ অনুপস্থিত মালিকদের মালিকানায় আছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে ভূমির সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করার জন্যে এ অনুপস্থিত মালিকানা নিষিদ্ধ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে মাহবুবুল আলম দুলাল বলেন, অনেক বিধবা, ক্ষুদ্র দোকানী, স্কুল শিক্ষক, কেরানী অফিসের দারোয়ান, পিয়ন, কারখানা শ্রমিক ইত্যাদি পেশার মানুষ অনুপস্থিত মালিক শ্রেণীভুক্ত হলেও নিজের ও পরিবারের জীবন ধারণের জন্যে নির্দিষ্ট জমির উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে অনুপস্থিত মালিকানা তুলে দেবার আগে তাদের স্বার্থের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।

No comments: