তাসনিমকে আটক করার পর আমাদের তথ্য অধিকার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। অবশ্য সাংবাদিক বা তথ্যকর্মী হিসেবে তাসনিমই প্রথম না। আরো অনেকে তাদের হাতে আটক ও নিগৃহীত হয়েছেন। আমরা বোধ হয় তথ্য অধিকার বিষয়েও কথা বলতে পারি।
যেসব দেশের নাগরিকদের তথ্য পাবার অধিকার বেশি সেসব দেশ বেশি দুর্নীতিমুক্ত আর সেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বেশি শক্তিশালী। তাই সেসব দেশে মানবাধিকারও বেশি নিরাপদ। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি তথ্য-অধিকারকে গণতন্ত্রের একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেন। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় সত্তরটি দেশে “তথ্য-অধিকার আইন” প্রণীত হয়েছে। আরো অনেক দেশে আইন প্রণয়নের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এসবের বেশিরভাগই ঘটেছে গত দু দশকে। অর্থাৎ, পৃথিবীতে গণতন্ত্রের প্রসার যত বাড়ছে তথ্য-অধিকার আইনও তত প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০০৫ সালের জুন মাসে তথ্য-অধিকার আইন প্রণীত হয়েছে প্রায় দশ বছর আন্দোলনের পর এবং অল্প সময়েই সেখানে এই আইনটি জনগণের মনে বিশেষ আগ্রহ ও আশার সঞ্চার করেছে। ভারতের স্বাধীনতার পর গত প্রায় ষাট বছরে যেসব আইন প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে এই আইনটিই শাসনব্যবস্থায় সবচেয়ে বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। সামরিক-শাসিত পাকিস্তানেও তথ্য-অধিকার অধ্যাদেশ জারি হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর হলো। শ্রীলঙ্কাও এ ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই দেখা যাচ্ছে, উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশই সবচেয়ে পিছিয়ে। তথ্য-অধিকার আইনের একটা খসড়া আমাদের আইন কমিশন ২০০২ সালেই তৈরি করেছিলেন। সেই খসড়ার ওপর মতামত দেবার জন্য তা অনেকের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তবে বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে গিয়ে অনেকদিন ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে থাকে। ২০০৬ সনে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান খসড়াটি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে এবং ইদানীং “মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন” কয়েকজন আইনজ্ঞকে নিয়ে আইন কমিশনের খসড়ার ভিত্তিতে আর একটি খসড়া দাঁড় করিয়েছে। আর সেটিকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাগরিক সভা হয়েছে এবং তা থেকে বেশ কিছু ভালো মতামতও এসেছে। বলা যায়, আইন তৈরির প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন বিষয়টি পরবর্তী সংসদে উত্থাপন করার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর এ নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কীভাবে অগ্রসর হতে হবে তা সংসদই ঠিক করবে। সাংসদদের সদিচ্ছা থাকলে, কিছু সময় লাগলেও, এ কাজ সম্পাদন করা কঠিন হবে না বলে আমার বিশ্বাস। খসড়া আইনের মূল বিয়য়গুলো সংক্ষেপে এই রকম ১) সংজ্ঞা : তথ্য বলতে সরকারি কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ড-সংক্রান্ত যেকোনো বস্তু বা তথ্যকে বোঝায়। সরকারি কাজে চিঠির আদান-প্রদান, মিটিংয়ের কার্যবিবরণী, ফাইলে ধরা বিভিন্ন কর্মকর্তার মতামত, স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, ছবি, অঙ্কন, ফিল্ম, যন্ত্রে-ধারণ করা শব্দ ও তথ্য এবং অন্য যেকোনো তথ্যবহ বস্তুকেই তথ্য বলা যায়। ২) এই আইনের ফলে দেশে যেসব গোপনীয়তা আইন বলবৎ আছে তা হয় বিলুপ্ত হবে, নইলে তাদের সংশোধন করা হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব, দেশরক্ষা-সংক্রান্ত তথ্য, বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক-সংক্রান্ত তথ্য, ইত্যাদি কিছু গুরুতর বিষয় এই আইনের আওতায় পড়বে না। এ ব্যাপারে সময়সীমা নির্ধারণ করার প্রয়োজন আছে কি না তা সংসদ বিবেচনা করে দেখতে পারে।৩) প্রস্তাবিত আইনের আওতায় সরকার বলতে জনগণের পয়সায় পরিচালিত সব রকম সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কোর্ট-কাচারি, সংসদ ইত্যাদিই শুধু নয়, যেসব প্রতিষ্ঠান দেশের আইন বা অধ্যাদেশ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তারাও প্রস্তাবিত আইনের আওতায় পড়বে। দেশের বেশির ভাগ এনজিও এর মধ্যে পড়বে। ৪) তথ্য-অধিকার বলতে তথ্য-প্রাপ্তির অধিকারকে বোঝায়। সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে রক্ষিত দলিলপত্র দেখার, তার সারমর্ম, ফটোকপি, সত্যায়িত নকল ইত্যাদি পাবার অধিকার এর মধ্যে পড়বে। তবে এর জন্যে জনগণকে সামান্য কিছু ফি দিতে হবে।৫) জনগণকে এইসব তথ্য প্রদানের জন্যে প্রত্যেক সরকারি অফিসে ‘তথ্য-কর্মকর্তা’ বা ‘ইনফরমেশন অফিসার’ নির্দিষ্ট করা থাকবে। তারা জনগণের আবেদনক্রমে তাদের কাঙ্খিত তথ্য সরবরাহ করতে বা পেতে সহায়তা করবেন। না পারলে লিখিতভাবে কারণ জানাবেন, নইলে শাস্তিযোগ্য হবেন।৬) আইনের প্রয়োগ ও তদারকির জন্যে ‘তথ্য-কমিশন’ ও ‘তথ্য-আপিল কমিশন’ গঠিত হবে, যেখানে অসন্তুষ্ট আবেদনকারীরা অভিযোগ করতে পারবেন।
No comments:
Post a Comment