(সাংবাদিক সাইফুল্লাহ কামরুলকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশপূর্বক লেখাটি পোস্ট করছি)
ক'দিন হরেই সাংবাদিকরা আইয়ে, লে-ই লই যায়। আঙ্গো কোনো উপকার অয় ন অ-ন। দাবি তিন আন কইচ্ছি, কতদিন অইছে। কই কেও খবর অ লয় ন ( কয়দিন পরই সাংবাদিকরা আসে এবং লিখে নিয়ে যায়। আমাদের কোনো উপকার হয়নি। তিনটি দাবি করেছি, কতদিন হয়েছে। কেউ খবরও নেয়নি)। কথাগুলো এক নিমিষেই বললেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের পু্ত্র শওকত আলীর স্ত্রী। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সেই দাবিগুলো জানতে চাইলে বললেন বাড়িতে বিদু্যতের সংযোগ, বাড়ির সংযোগ রাস্তাটি সংস্কার আর তার স্বামীর চিকিৎসা। আশ্চর্যজনক হলেও সে দাবির প্রতি কেউ কর্ণপাত করেনি। মার্চ এবং ডিসেম্বর মাস এলেই সাংবাদিকদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাঁচরা গ্রামের বাড়িতে। সাংবাদিকদের উৎপাতে তারা অনেকটাই বিরক্ত। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যে ৭জন বীর শ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন তাদের অন্যতম হচ্ছেন এক সময়ের বেগমগঞ্জ উপজেলা বর্তমানে সোনাইমুড়ী উপজেলার দেউটি ইউনিয়নের বাগপাঁচরা গ্রামের রুহুল আমিন। যুদ্ধের চুড়ান্ত বিজয়ে মাত্র ৬ দিন পূর্বে ১০ ডিসেম্বর খুলনার রূপসায় শাহাদাত বরণ করেন এই বীরযোদ্ধা। ১৯৩৪ সালে বাগপাঁচরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রুহুল আমিন। ৩ভাই ও ৪ ভাই নিয়ে ছিলো তাদের সংসার। শিক্ষা জীবন শুরু করেন বাগপাঁচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার পর ভর্তি হন আমিশাপাড়া কৃষক উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৫১ সালে নৌ-বাহিনীতে নায়েক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। যুদ্ধকালীন সময়েই অসুস্থ হয়ে মারা যান তার পিতা-আজহার মিয়া এবং তার স্ত্রী জাকিয়া খাতুন। বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের তিন মেয়ে দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছে। তিন মেয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ফিরোজ শাহ কলোনীতে নৌ-বাহিনীর দেয়া বাড়িতেই থাকে। এছাড়া নৌ-বাহিনীর পক্ষ থেকে গ্রামের বাড়ি বাগপাঁচড়ায় দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি পাকা দালান নির্মাণ করে দেয়া হয় ২০ বছর পূর্বে। এই বাড়িতেই স্ত্রী এবং দুই বছর বয়সের কন্যা সন্তান নিয়ে থাকে বীরশ্রেষ্ঠের পুত্র শওকত আলী। মানসিক ভারসাম্যহীন শওকত আলীর সংসার চলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ভাতার টাকা দিয়ে। চট্টগ্রাম থেকে বড় বোন নুরজাহান নার্গিস ভাতার টাকা উত্তোলন করে তার জন্য পাঠায় প্রতিমাসে। যা দিয়েই চলে শওকত আলীর সংসার। বীরশ্রেষ্ঠের গ্রামের বাড়িতে পেঁৗছে মনে হয়েছে কোনো বিত্তশালীর পরিত্যক্ত বাড়ি এটি। চারদিকে ঝোঁপঝাড়। নৌ-বাহিনী দালানটি নির্মাণ করে দেয়ার পর আর কোনো সংস্কার হয়েছে বলে মনে হয়নি। বাড়িতে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন সংক্রান্ত কোনো তথ্য সংরক্ষিত নেই। উঠানে চুলায় রান্না করছিলেন শওকত আলীর স্ত্রী। তিনি বীরশ্রেষ্ঠের বোনের মেয়ে বিধায় পরিবারের বয়োজৈষ্ঠ্যদের কাছে থেকে শোনা কিছু তথ্য জানাতে পেরেছেন। শওকত আলীকে খোঁজ করতে একজন গিয়ে তাকে দোকান থেকে ডেকে আনেন। ময়লা জামা আর লুঙ্গি পরিহিত শওকত আলীকে দেখে মনে হয়নি সে তার বাবা এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলো। সাংবাদিক পরিচয় দিতে কিছুটা বিরক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত বলেছেন দুঃখের কথা। বললেন সাংবাদিকরা এসে তাদের স্বাক্ষাৎকার নিয়ে যায় টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয় এবং পত্রিকার পাতায় তা প্রকাশ করা হয় বলে তিনি শুনেছেন কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি একমাত্র নৌ-বাহিনী ছাড়া। নিজেকে কোরআন হাফেজ বলে জানালেন। পড়াশোনা কতটুকু করেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন 'আন্ডার মেট্রিক'। পাগল বলে মানুষ কোনো কাজ দেয়না উপরন্তু ক্ষেপিয়ে তোলে। তখন মাথা বিগড়ে যায়। তার চিকিৎসা, বাড়ির রাস্তাটি মেরামত এবং ঘরে বিদু্যৎই তার এখন মূখ্য দাবি। বিদু্যৎ দিয়ে কি হবে প্রশ্ন করতেই স্মিত হেসে উত্তর দিলেন, বাত্তি টাত্তি জালামু আরকি। গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেগমগঞ্জ-সোনাইমুড়ী আসন থেকে স্বাধীনতা পরবতর্ীকালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন একাধিক মুক্তিযোদ্ধা, বাণিজ্য উপদেষ্টা ও যুবদল সভাপতি বরকত উল্যা বুলু ১০ বছর ধরে সংসদ সদস্য ছিলেন, পরবর্তীতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেম এমপি এখানকার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, এছাড়া এ এলাকায় রয়েছে ডজন খানেক শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি এবং আমলার বাড়ি কিন্তু রুহুল আমিনের পরিবারের দুরবস্থা নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামাননি। বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনকে ঘিরে বাগপাঁচরায় ১৯৯৪ সালে নির্মিত হয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন একাডেমি। স্থানীয়দের উদ্যোগে এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্বয়ং নৌ-বাহিনীর তৎকালীন প্রধান রিয়ার এডমিরায় মোহাইমেনুল ইসলাম উপস্থিত থেকে ১ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। বেগমগঞ্জের চৌরাস্তায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্মৃতিস্তম্ভ। যা এখন ট্রাফিক আইল্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দশম শ্রেণীর ছাত্র জাবেদ হোসেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন একাডেমির ছাত্র হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। তার মতে সারাদেশের ৭জন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে তাদের এলাকায় রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের বাড়ি। এ একাডেমি হওয়ায় এলাকায় শিক্ষার হার বেড়েছে। সে নিজেও লেখাপড়া করতে পারছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করতে পারছে । বীরশ্রেষ্ঠের বাল্যকালের বন্ধু খালেক মোল্ল্লা জানলেন, অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের রুহুল আমিনসহ তিনি পড়াশোনা করেছেন বাগপাঁচরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাল্য বন্ধুদের মধ্যে তিনি বেঁচে আছেন এবং গর্ববোধ করেন একজন বীরশেষ্ঠের বন্ধু হিসেবে।
No comments:
Post a Comment