Tuesday, July 31, 2007

স্থানীয় সাংবাদিকতায় সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ তৃণমূল স্তরে সুশাসন ব্যাহত

সংবাদপত্রকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তৃণমূলে কতখানি গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে, গণতন্ত্র চর্চায় কি কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে জনগণ সরকার থেকে কি ধরণের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা ও তার সমাধান কি হতে পারে এ সকল কিছুই উঠে আসে স্থানীয় সংবাদপত্রে। মূলতঃ স্থানীয় সংবাদপত্র শাসক গোষ্ঠী ও জনগণের মাঝে মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কিšদ স্থানীয় সংবাদপত্র প্রকাশেও রয়েছে বিবিধ সমস্যা।বৈষম্যহীন সমাজ, সুষ্ঠু সমন্বিত উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সাংবাদিকতার প্রয়োজন অপরিহায্য। স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার বিকল্প ও সংবাদপত্র প্রকাশনায় গতিশীলতা বৃদ্ধি সুশাসন নিশ্চিত করার জন্যে অপরিহার্য।যে কোন ধরণের ধারণার চর্চা করতে হয় তৃণমূল থেকে। মফস্বলে অবস্থান করছে আমাদের তৃণমূল সমাজ। সুষম বন্টন ব্যবস্থায় কোন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া আমাদের দেশে গড়ে না উঠায় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী তৃণমূল সমাজ তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, সহকারি, বেসরকারি অসহযোগিতা, শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। চর্চা হচ্ছে না গণতন্ত্রের। অথচ দেশ এখন গণতান্ত্রিক শে¬াগানে মুখরিত। জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে সুশাসন থেকে।স্থানীয় সকল সমস্যা একমাত্র সংবাদপত্রই প্রকাশ করতে পারে। সংবাদপত্রকে মনে করা হয় জনগণের সদাজাগ্রত লোকসভা বলে। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের সুশাসন প্রাপ্তির অধিকার যেমন রয়েছে তেমনি সংবাদপত্র এ বিশাল জনবসতির সাথে মহামিলন ঘটিয়ে দিতে পারে। স্থানীয় সংবাদপত্র পারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে। সরেজমিন পরিদর্শন, সংশি¬ষ্টদের সাথে আলাপে জানা যায়, স্থানীয় সংবাদপত্রও এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ব্যর্থতার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: স্থানীয় পত্রিকার ডিক্লারেশনে সমস্যা, আর্থিক দৈন্যতা, বিজ্ঞাপন প্রাপ্তিতে সমস্যা, প্রশাসনের অসহযোগিতা, দক্ষ সংবাদকর্মীর অভাব, ব¯দনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের চাপ, ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে পত্রিকা প্রকাশ করা ইত্যাদি। সরকার ও সচেতন মহল স্থানীয় সংবাদপত্র প্রকাশে যথাযথ সহযোগিতার হাত বাড়ালেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে সকল মহলের ধারণা।
নোয়াখালীর সংবাদপত্র: নোয়াখালী জেলার সংবাদপত্রের ইতিহাসে দেখা যায়, স্থানীয় সংবাদপত্র জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠায় কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ১৮৭৪ সালে বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে থাকা অবস্থায় নোয়াখালী অঞ্চলের লোকজন ‘ঢাকা প্রকাশ’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও আর্থিক সহযোগিতা না পাবার কারণে সংবাদপত্রটি শেষ নাগাদ প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। নোয়াখালী থেকে প্রথম প্রকাশিত পত্রিকার নাম সাপ্তাহিক ‘পূর্ব বঙ্গবানী’। ১৮৮৮ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায় প্রকাশের মাত্র চার বছরের মাথায়।স্বাধীনতাপূর্ব বৃটিশ আমলে,পাকিস্তান শাসনামলে এ জেলায় প্রচুর সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর প্রায় সবগুলোই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৩০ বছরের মধ্যেও নোয়াখালীতে প্রচুর সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। কিšদ তার অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সংবাদপত্র প্রকাশনার ধারাক্রমটিকে মোট চার পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ বৃটিশ শাসনকাল- সংবাদপত্র বিকাশের সূচনাপর্ব। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তান শাসনামল পর্ব। তৃতীয়তঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তীকাল। চতুর্থতঃ নতুন জেলাভিত্তিক প্রশাসনিক বিন্যাস পরবর্তী।
ডিক্লারেশন: নজরানা যেন ফাইলের জীবনিশক্তি: জাতীয় পত্রিকাসমূহে স্থানীয় সংবাদ কম আসে বলে স্থানীয় জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরার জন্যে স্থানীয় পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। কিšদ স্থানীয় পত্রিকার ডিক্লারেশন পেতে অনেক খড়কাঠ পোহাতে হয়। এর জন্যে প্রথমে জেলা প্রশাসক বরাবরে দরখাস্ত করে ডিএফপি থেকে পত্রিকার নামে ছাড়পত্র আনতে হয়। এরপর ডিএসবি, এসপিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন টেবিল ঘুরে পত্রিকার ডিক্লারেশন ফাইল আলোর মুখ দেখে। কিšদ টেবিলে টেবিলে ফাইল চালনা করতেই সমস্যা হয় সবেচেয়ে বেশি। পত্রিকা ডিক্লারেশনের জন্যে বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ প্রদান করতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ হলে তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পত্রিকা প্রকাশনায় ইচ্ছে আছে, অর্থ নেই:ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টারের একদল কর্মীবাহিনী নোয়াখালীর বিভিন্ন সংবাদপত্র কার্যালয় পরিদর্শন করেন। পরিদর্শক দল পত্রিকার সম্পাদক, মালিক এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকার সম্পাদকের সাথে কথা বলেন। এ পরিদর্শনকালে যে তথ্যটি বেরিয়ে আসে তাহল, সকল পত্রিকার সম্পাদকদেরই পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছে আছে কিšদ তারা আর্থিক দৈন্যতার কারণে পত্রিকা প্রকাশ করতে পারছেনা। সরকারি বেসরকারি বিজ্ঞাপন না পাওয়ার কারণে অনেক পত্রিকাই বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়েকটি পত্রিকা এখনো টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশই সম্পাদকদের নিজ পকেটের টাকায় ছাপা হয় বলে জানান নোয়াখালী কন্ঠের সম্পাদক। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সংবাদকর্মীদের কোন সম্মানী দিতে পারে না ফলে সংবাদকর্মীরা এ পেশা ছেড়ে দিয়ে বিকল্প পেশায় চলে যায়। অবশ্য যথাযথ সম্মানীছাড়া যে কেন কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করাও ঠিক নয়। তাই জীবনের তাগিদে তারা অন্য পেশায় যুক্ত হয়। এতে করে স্থানীয় সংবাদগুলো প্রশিক্ষিত সংবাদকর্মী পায় না। পত্রিকা প্রকাশের জন্যে অর্থনৈতিক যোগান অবশ্যই দরকার সেজন্যে ডিএফপি কেন্দ্রীয়ভাবে বিজ্ঞাপন বন্টন বন্ধ করে স্থানীয়ভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত।
মালিক যিনি সম্পাদক-সংবাদকর্মীও তিনি: স্থানীয় পত্রিকাকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সচল রাখার জন্যে যে পরিমাণ দক্ষ লোকবল প্রয়োজন সেটি একেবারে নেই বললেই চলে। নোয়াখালী থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ পত্রিকার সাথে যুক্ত রয়েছে কিছু তরুন। যারা সাংবাদিকতার দায়িত্ব ও লেখালেখির দক্ষতা সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই রাখেন না। কোনরূপ প্রশিক্ষণ ছাড়া একসময় এ রকম লিখতেন মোঃ হারুনুর রশিদ বলেন, সমাজের নানা ধরণের মানুষের সাথে বাস করতে গিয়ে যে ঘটনাটি আমার কাছে অ-স্বাভাবিক মনে হতো সাধারণতঃ সেই ঘটনা দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতাম। তাছাড়া সংবাদ লেখার আলাদা কাঠামো আছে, লেখার কৌশল আছে এ ধরণের কোন ধারণাও রাখতাম না। সাংবাদিকতার মাধ্যমে যে একটি মহৎ কাজ সম্পন্ন হয় সে কথা আজকে অনেকেই বিশ্বাসই করে না। প্রত্যেকে এ সকল কাজকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখে। চৌমূহনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পূর্বশিখার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম হারুন বলেন, কিছু আগ্রহী তরুন খুব আগ্রহ নিয়ে মাঝে মধ্যে লেখালেখি শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত আমরা আর্থিক দৈন্যতার কারণে তাদেরকে যথাযথ সম্মানী দিতে পারিনা বলে পরবর্তীতে তারা অন্য যে কোন পেশায় চলে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক বলেন, স্থানীয় পত্রিকাগুলো সাধারণত দু’একজনের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় নামকা ওয়াস্তে দু’একজনের নাম ব্যবহারই হয় মাত্র। কার্যত একজন ছাড়া বাকী কেহ প্রকাশনায় যুক্তও থাকেনা। এতে সম্পাদক যিনি সংবাদকর্মীই তিনি। আবার সংবাদকর্মী যিনি মালিকও তিনি।
স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, অযথা খরচ: পত্রিকা প্রকাশের জন্যে প্রয়োজন আর্থিক সঙ্গতি। আর এ আর্থিক স্বচ্ছলতার একটি উপায় সরকারি ও বেসরকারি বিজ্ঞাপন। কিšদ স্থানীয় পত্রিকার জন্যে প্রচলিত বিজ্ঞাপন নীতি রয়েছে তা খুবই বৈষম্যমূলক। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও রয়েছে সমস্যা। স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ শিল্প কারখানা না থাকার কারণে বেসরকারি অবস্থান থেকেও তেমন কোন বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে নোয়াখালী কন্ঠ সম্পাদক আফতাব উদ্দিন বাচ্চু বলেন, বেসরকারিভাবে যাদের দুএকটি কল কারখানা আছে তারা মনে করে স্থানীয় পত্রিকার পাঠক কম। কম মানুষই স্থানীয় সংবাদপত্র পড়ে। তাই স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলে তাদের প্রচার-প্রসার কম হবে ভেবে তারা জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রদানকে তারা অযথা খরচ বলে মনে করেন। সাপ্তাহিক ফয়সালা পত্রিকার সম্পাদক আবু জাফর বলেন, ‘সরকারি পর্যায় থেকে স্থানীয় পত্রিকাগুলো যে ছিঁটেফোটা বিজ্ঞাপন পায় তাতে তেমন একটা সাশ্রয় হয় না।’ সরকারি দুএকটি বিজ্ঞাপন পাওয়া গেলেও বিজ্ঞাপনের বিল প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় পত্রিকাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হলে স্থানীয় বিজ্ঞাপনগুলো স্থানীয় পত্রিকায় দেওয়া উচিত। স্থানীয় পত্রিকার সাথে যেহেতু আম জনতার জীবন জীবিকার যোগসূত্র থাকে তাই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানটির সাথে জনতার মিলন অটুট রাখার জন্যে স্থানীয় সংবাদপত্রও অত্যাবশ্যক।অমুক ভাইয়ের সংবাদ ছাপা যাবেনা: সাংবাদিকরা অনেক সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও প্রশাসনিক দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ ছাপার ফলে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল প্রশাসন কর্তৃক হুমকির সম্মুখীন হতে হয়। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে এমন অনেক ঘটনা আছে বলে বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপকালে জানা যায়।ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির কথা পত্রিকায় প্রকাশ করায় স্থানীয় সাংবাদিকরা নোয়াখালী কোম্পানীগঞ্জ থানার বসুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান আঃ কাদের মীর্জার রোষানলে পড়তে হয়। তিনি জনসম্মুখে সাংবাদিকদের গালিগালাজ করেন। এমনকি তার দুর্নীতির বিষয়ে লেখার ফলে অনেক সাংবাদিককে এলাকা ছেড়ে ফেরারী জীবন যাপন করতে হয়। এছাড়াও ফেনীতে সত্য ও ব¯দনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করার অপরাধে সাংবাদিকদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি এ সকল গোষ্ঠীর চাপে কয়েকটি স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়। একই ঘটনা ঘটে লক্ষ্মীপুরে। সেখানে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান বিভিন্ন দুর্নীতি, অন্যায়, নির্যাতন, খুন ইত্যাদির কথা স্থানীয় সাংবাদিকরা পত্রিকায় তুলে ধরলে তিনি তৎকালীন একজন মন্ত্রীর সামনে জনসম্মুখে সাংবাদিকদের হাত-পা কেটে ফেলার হুমকি দেন। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক আফতাব উদ্দিন বাচ্চু বলেন, স্থানীয় পত্রিকার কোন সংবাদ ছাপাতে হলে স্থানীয় গড ফাদারদের অনুমতি নিতে হয়। কোন সংবাদটি ছাপানো যাবে কোনটি যাবে না তা স্থানীয় টাউটরা সম্পাদকদের পরামর্শ দেন। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এ সকল কথা উপেক্ষা করার কারণে একটি রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা তার পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে। হুমকি, ভীতি, রাজনৈতিক চাপ ইত্যাদি কারণে জাতীয় ও স্থানীয় পত্র পত্রিকায় গ্রামের খবর প্রবাহের হারও খুবই নগন্য।
প্রশাসন ভাবে সাংবাদিক নয় যেন গোয়েন্দা: সাংবাদিকরা স্থানীয় প্রশাসনের যথাযথ সহযোগিতা পায় না। প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ডাকার নিয়ম থাকলেও তাদের তেমন একটা ডাকা হয় না। আবার অনেক সময় প্রশাসন কেবল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনকারী সাংবাদিকদের ডাকে। এছাড়াও সাংবাদিকরা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনরূপ তথ্য চাইলেও তারা দিতে চায়না। সাংবাদিকদের কোন প্রকার তথ্য প্রদান করা হলে তাদের বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ফাঁস হয়ে যাবে এ ধারণা থেকে তারা কোন তথ্য দেয় না। এছাড়াও প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়মের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ করার অভিযোগে অনেক সাংবাদিককে অতীতে মামলা ও গ্রেফতার বরণ করতে হয়েছে। প্রশাসনে যে কোন তথ্যের জন্যে গেলে তাদের সোজা কথা উপরস্থ অনুমতি ছাড়া দেওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে সমাজকর্মী মামুনুর রশিদ বলেন, সাংবাদিকরা প্রশাসন ও জনগণের মাঝে মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে এবং প্রশাসনের তাই মনে রাখা উচিত। কিšদ তারা সাংবাদিকদের সাংবাদিক মনে না করে গোয়েন্দা মনে করে। এতে করে জনজীবনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেকাংশে ব্যাহত হয়।
সাংবাদিকের প্রশিক্ষণ যেন মালিকের অপচয়: সারাদেশে সাংবাদিকের সংখ্যার তুলনায় দক্ষ সাংবাদিকের পরিমাণ অত্যন্ত কম। স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরা দক্ষতা উন্নয়নের জন্যে তেমন কোন প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় না। আর এই অদক্ষতা জন্যেই স্থানীয় সাংবাদিকরা সংবাদমূল্য নির্ধারণে অনেকাংশে ব্যর্থ হন। ফলে সংবাদ হওয়ার মত সংবাদও যথাযথভাবে উপস্থাপন হয় না। দৈনিক মাতৃভূমি নোয়াখালী জেলা প্রতিনিধি মিরন মহিউদ্দিন জানান, তৃণমূল পর্যায়ে প্রাত্যহিক জীবনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, উন্নয়ন বিষয়ক হাজারো ঘটনা ঘটছে। আবার অনেক সুপ্ত ঘটনাই আছে যেগুলোর সাথে বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংশি¬ষ্ট। কিšদ প্রশিক্ষিণের অভাবে বর্তমানে অনেক সংবাদকর্মীই সে সকল ঘটনাকে এড়িয়ে চটক সংবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে।সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সাংবাদিকতার রয়েছে বিশাল ভূমিকা। এমন ঘটনাই আছে যেগুলো সংবাদপত্রে প্রকাশের পর জনগণ তার প্রতিকার পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রশিক্ষিত একজন সংবাদকর্মী বলেন, নোয়াখালীর স্থানীয় সংবাদপত্র লোক সংবাদ কোম্পানীগঞ্জে চর দখলকারীরা ৯টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, রায়পুরে মাছ ঘাট, বয়ারচরের উপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদকমূলক সংবাদ প্রকাশের পর সংশি¬ষ্ট সাধারণ মহল এ বিষয়ে প্রতিকার পেয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষও তাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছে। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সংবাদের রয়েছে শক্তিশালী অবদান। কিšদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের অভাবে স্থানীয় সংবাদ পত্র-পত্রিকায় কর্মরত সংবাদকর্মীদের মধ্যে জনগণ, সংবাদপত্র ও প্রশাসনের সাথে সম্পর্কের প্রকৃতি যেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কিত ধারণার অভাব রয়েছে। সেই সাথে সমাজের সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতার অভাবে সংবাদপত্রগুলো স্থানীয় জনতার দুঃখ দুর্দশা ও চাওয়া পাওয়ার মুখপাত্র হয়ে উঠছে না। জনগণও সে কারণে স্থানীয় সংবাদপত্রের মুখাপেক্ষী হয়ে উঠছে না।স্থানীয় কিছু উৎসাহী যুবক সাংবাদিক পরিচয়ে আনন্দবোধ করে বলে তারা স্থানীয় পত্রিকাদির সাথে জড়িত থাকে। কিšদ তাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। ফলে সংবাদপত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উঠে আসে না। যদি সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণ থাকতো এ সমস্যা হতো না। এ সমস্যা সমাধানের জন্যে পিআইবিসহ দু’একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মাঝে মধ্যে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের জন্যে প্রশিক্ষণের আয়োজন করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ ধরণের প্রশিক্ষণের জন্যে যে পরিমাণ অর্থ দরকার তা স্থানীয় অনেক পত্রিকারই নেই। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠান পত্রিকার অর্থ যোগান দেবার সুযোগ থাকলেও স্থানীয় সংবাদকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশ্নে তারা অনীহা দেখায়। এ প্রসঙ্গে নোয়াখালীতে কর্মরত একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদক বলেন, সংবাদকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে অর্থ খরচ করাকে মালিকপক্ষ অহেতুক অপচয় বলে মনে করে।
পত্রিকা নয় যেন তোষামোদনামা: সংবাদপত্রকে জনমানুষের মহামিলন কেন্দ্র বলা হলেও কিছু কিছু স্থানীয় সংবাদপত্র মাঝে মাঝে শিল্পপতির বায়না বা তোষামোদ করে প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক মিরণ মহিউদ্দিন বলেন, আসলে এজন্যে আর্থিক দৈন্যতাই দায়ী। অর্থাভাবে সম্পাদক পত্রিকা প্রকাশ করতে অপারগ হলে কোন বিশেষ ব্যক্তির দ্বারস্থ হন। আর সে ব্যক্তির নিকট থেকে কোন প্রকার সাহায্য পেল তার পক্ষে হয়ত দু’এক কলম লিখে। যদিও তা মোটেই ঠিক নয়। মাঝে মাঝে দেখা স্থানীয় পত্রিকাগুলোর কোন কোনটি সংবাদপত্রের আদ্যোপ্রান্তে একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার, জীবন বৃত্তান্তসহ কেবল একজন মানুষকে নিয়ে লিখে থাকে। এ ক্ষেত্রে পত্রিকাটি কিšদ উক্ত ব্যক্তির বিজ্ঞাপনপত্রে পরিণত হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক বলেন, আসলে কিছু কিছু সম্পাদক আছেন তারা পত্রিকার নাম ভাঙিয়ে শিল্পপতিদের কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে একটি সংখ্যা বের করে উক্ত ব্যক্তির খানিকটা তোষামোদ করে। আর বাকী টাকা দিয়ে নিজের উদর পূজা করে। এতে করে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হন। এ সকল কাজগুলো যে কোন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের বা সময়ের আগে ঘটে থাকে বলে সাধারণ মানুষ সে ব্যক্তির ইতিবাচক নেতিবাচক কোন খবরাদি না জেনে উক্ত ব্যক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ফলে জনসাধারণ নেতা নির্বাচনের সময়ও শঠতার শিকার হন। নগর বার্তা বনাম পল¬ী বার্তা>বিপাকে পাঠক: রাজধানী থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো নানা রঙে প্রকাশিত হয় বলে পত্রিকাগুলোর প্রতি পাঠকের আগ্রহ থাকে খুব বেশি। স্থানীয় পত্রিকাগুলো লেটার প্রেসে হালকা ও ঝাপসা অক্ষরে ছাপা হয় বলে পাঠক পত্রিকার প্রতি তেমন আগ্রহী হয়ে উঠে না। গ্রামের একজন সাধারণ পত্রিকা পাঠক কামাল উদ্দিন বলেন, স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে সাধারণত কিছু হার্ড নিউজ থাকে। এছাড়া পাঠকের জন্যে আলাদা কোন বিভাগ থাকে না। কিšদ ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন বিভাগ থাকে বলে তারা বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারে। তাছাড়া স্থানীয় পত্রিকাগুলো মাঝে মাঝে জাতীয় পত্রিকাগুলোর নিউজ, প্রবন্ধ, কলাম পুনরায় ছাপিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেন। স্থানীয় পত্রিকাগুলোর অন্যতম একটি পাঠক স্বল্পতা। স্থানীয় পত্রিকা বৈশিষ্ট্য ও গুণ ঠিকমত থাকে না বলে এ সমস্যা। পত্রিকা পাঠক কামাল উদ্দিন আরো বলেন, অনেকে শহরের চটক খবর পাঠে বেশি আগ্রহী। তারা সাধারণত খুটিয়ে খুটিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ে। স্থানীয় সংবাদ সম্পর্কে তারা জানতে চাইলে জানতে পারে কম। কেননা জাতীয় পত্রিকাগুলোতে মফস্বলের জন্যে মাত্র ২/১টি পাতা বরাদ্দ থাকে। তাতে ৬৮ হাজার গ্রামের ছবি ভেসে উঠে না। বাংলাদেশ প্রেস ইনিষ্টিটিউটের সাময়িকী নিরীক্ষা’য় (৫৮তম সংখ্যা ১৯৯২) প্রকাশিত রচনায় গবেষক সীমা মোসলেমের তথ্য মোতাবেক ঢাকা থেকে প্রকাশিত পাঁচটি জাতীয় দৈনিকে আট দিনের সংবাদ অংশের মধ্যে মফস্বল সংবাদে অংশ দৈনিক সংবাদ ৩৮.৯৮%. দৈনিক ইত্তেফাক ২০.৮৮%, দৈনিক ইনকিলাব ১৯.১৯%, দৈনিক বাংলা ১৭.৮৭%, বাংলাদেশ অবজারভাব ১২.৬১%। অথচ গ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ। কিšদ জাতীয় পত্রিকায় গ্রামের জন্যে বা স্থানীয় খবরের জন্যে জায়গা খুব কম। গ্রামের পাঠক যেমন শহরের সংবাদের অন্বেষণ করে তেমনি শহরের পাঠক ও গ্রামের সংবাদের খোঁজে থাকে। কিšদ সংবাদ প্রকাশের যথাযথ উপায় না থাকায় দু শ্রেণীর পাঠকই হতাশ হন। স্থানীয় সংবাদপত্রের এ শূন্যতা সম্পর্কে সাপ্তাহিক ফয়সালার সম্পাদক বলেন, মফস্বলে রয়েছে প্রযুক্তিগত সমস্যা। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো ছাপা হয় লেটার প্রেসে। এখানে আধুনিক অফসেট প্রেসও প্রযুক্তির রয়েছে অভাব। হাতিয়ায় নেই কোন প্রেস। ফলে সেখানকারপত্রিকাগুলো জেলা শহর থেকে সম্পাদকগণছাপিয়ে নিয়ে যান। পত্রিকা গুণগত মান ও বৈশিষ্ট্য ঠিক করা সম্ভব হলে স্বল্প পাঠক সমস্যা যেমন দূর হবে তেমনি পাঠককেও গ্রামের খবর শহরের খবর খুঁজতে হবে না। মান সম্মত পত্রিকা প্রকাশ হলেই মানুষের কেন্দ্রানুগ মানসিকতা লোপ পাবে। সম্পাদক ও সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা । পত্রিকার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করে স্থানীয় সমস্যা ও সমাধানের প্রতিবেদন উপস্থাপন সহ প্রশাসনিক যাবতীয় সহযোগিতা প্রদান করা দরকার। এছাড়া ডিএফপি বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপননীতি বদল করা যেতে পারে। স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্যে বিজ্ঞাপন দাতাদের উৎসাহীত করার দরকার। ১০ বছর পূর্বে প্রকাশিত পত্রিকা ডিএফপি অডিট গ্র“ফের আওতা থেকে মুক্ত করা যেতে পারে।

Monday, July 30, 2007

অভাব অনটন ভাগচাষীদের নিত্য সঙ্গী


সরকারি নিয়ম-নীতির বদলে গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় রীতি মোতাবেক ভাগ চাষ হচ্ছে। এতে ভাগচাষীরা জমি মালিকদের কাছে শ্রম শোষণের শিকার হচ্ছেন।
ভাগচাষীদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ও চাষীরা মোট শ্রমের অর্ধেক বিনা হিসেবে জমি মালিকের গোলায় চলে যায়। ভাগচাষীরা জমি মালিকদের ভূমিদাসে পরিণত হয়।
জলাবদ্ধতার কারণে নোয়াখালীর অধিকাংশ জমি এক ফসলি জমিতে পরিণত হওয়ায় প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের বছরের বেশিরভাগ সময় বেকার থাকতে হয়। ফসলের মৌসুমে যে পরিমাণ কাজের লোক দরকার তার চাইতে বেশি পরিমাণ বেকার লোক পাওয়া যায়। ফলে গ্রামে কৃষিকাজের জন্য শ্রম বিক্রি করার সুযোগ থাকে না বিধায়ও অনেকে ভাগচাষ করে।
ফসল ওঠার পর ভাগচাষীরা উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক জমি মালিকদের ঘরে পৌঁছে দেয়। আর ভাগচাষীরা ফসলের উৎপাদন খরচ ও উৎপাদনের পেছনে ব্যয়িত শ্রমের বদলে অর্ধেক ফসল পায়। জমির মালিক জমি কেনার সময় মূলধন জাতীয় কাজের বিনিময়ে ভাগচাষীর উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ও ভাগচাষীর মোট শ্রমের অর্ধেক নিজের গোলায় ওঠিয়ে নেয়। অথচ ভাগচাষীদের এ শ্রমের কখনো মূল্য নির্ধারণ হয় না। এতে ভাগচাষীরা ফসল উৎপাদন মৌসুমে অন্যত্র শ্রম বিক্রি না করে ভাগের ফসলের আশায় বসে থাকার ফলে বছরের অধিকাংশ সময় অভাবে থাকতে হয়। এ অভাব ঘোচানোর জন্য অনেক ভাগচাষী মহাজনি ঋণ ও ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করেন। এক সময় ঋণের জটিল চক্রে জড়িয়ে কৃষকদের me©¯^vš— হতে হয়।
১৯৮৪ সালে জারিকৃত ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশের ভাগচাষীদের ¯^v_© সংরক্ষণের যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভাগচাষীদের শ্রম শোষণের হাত থেকে কিছু রক্ষা সম্ভব। নোয়াখালীর ভাগচাষী, জমি মালিক, স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপে এ তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রামাঞ্চলে যাদের কোনো জমি নেই তারা অন্যদের জমি ভাগে বা বর্গা চাষ করে। এছাড়াও যাদের জমি কম এবং যারা ইতোপূর্বেও কৃষক ছিলেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে জমি বিক্রি করে ফেলেছেন তারাও অন্যদের জমি ভাগ চাষ করে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, নোয়াখালীর একেক এলাকায় একেক নিয়মে ভাগ চাষ হয়ে থাকে। বড়রামদেবপুর আইপিএম ক্লাবের সহ-সভাপতি মাইন উদ্দিন জানান, যদি উৎপাদন খরচের অর্ধেক চাষী ও অর্ধেক মালিক দেয় তাহলে ফসল ভাগের সময় তা অর্ধেক অর্ধেক হয়। আবার উৎপাদনের সময় হালের খরচ, সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদির খরচ চাষী দিলে উৎপাদিত ফসল তিনভাগ হয়। তিন ভাগের দুই ভাগ চাষী ও একভাগ জমির মালিক পায়। চাটখিলের মোহাম্মদপুর গ্রামের শাহ আলম জানান, চাটখিল উপজেলার কিছু জায়গায় ভাগচাষী ফসল চাষের সময় সার, বীজ, কীটনাশক, হালের খরচ সব দেয়। তারপর ফসল উঠলে জমির মালিক ফসল উৎপাদন খরচ বাবদ কিছু ধান ভাগচাষীকে দিয়ে দেয়। বাকি ফসল দু ভাগ করে একভাগ ভাগচাষী ও অন্যভাগ মালিক নিয়ে যায়। চাটখিলের শোল­া গ্রামের বেলাল জানান, জমির মালিক পানি সেচ খরচ অথবা সারের খরচ দেয়। বাকি সব খরচ ভাগচাষীকেই দিতে হয়। কিন্তু ফসল ভাগ দুই ভাগেই হয়।

সোন্দলপুরের আবুল হোসেন বলেন, আমাদের এলাকার কিছু অংশে আরেক নিয়ম আছে। সেটি হলো যে জমিতে ধান ও রবিশস্য ফলে সেগুলো আর্থিক মূল্যে বর্গা দেওয়া হয়। যেমন জমিতে ধান আবার শীতে সবজি চাষ করা হয়। জমির মালিক একজনের কাছে জমিতে বর্গা দিয়ে বলেন, এ জমি থেকে তুমি বছরে যা উৎপাদন কর তা তোমার বিষয়। তবে আমাকে বছরে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। এভাবে টাকা পরিশোধের মাধ্যমেও গ্রামাঞ্চলে ভাগ চাষ হয়ে থাকে। তবে এ জাতীয় চাষকে ঠিকা চুক্তিতে চাষও বলা হয়। অনেকে জানান, কৃষির কোনো উন্নতি ব্যতিরেকে বর্তমানের নিম্ন উৎপাদনে এই চুক্তিতে মালিকদের সুবিধা ভাগ চাষের চেয়ে বেশি।
ভাগচাষের জন্য একটি চুক্তি থাকার নিয়ম থাকলেও তা গ্রামাঞ্চলে মানা হয় না। বর্গাচাষী হোসেন মিয়ার গ্রাম সোন্দলপুরে। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় কোনো চুক্তি হয় না। মালিক মুখে বলে দেয় চাষ করার জন্য। এভাবে ভাগচাষীও চাষ করে।
শোল­া গ্রামের বেলাল জানন, জমি মালিকও ভাগচাষী একই গ্রামের হওয়াতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু কোনো কারণে যদি দুজনের মধ্যে কোনো রকম সমস্যা দেখা দেয় তখন চুক্তির দরকার হয়। কিন্তু সে সময় চুক্তিও থাকে না। ফলে জমির মালিক যা বলে তাই হয়।

লিখিত চুক্তির বিষয়ে জানতে গিয়ে দেখা যায়, জমি মালিক ও ভাগচাষী উভয়ই বিষয়টি হালকা চোখে দেখে। বিশেষত জমির মালিকরা মনে করেন, আমার জমিন আমি বর্গা দেব, তাতে চুক্তি করব না।
অনেক ভাগচাষী চুক্তি করার নিয়মের কথা জানলেও তারা তা বলে না। এ না বলার পেছনে এক ধরনের ভয় কাজ করে। কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, গ্রামের অনেকে জমি ভাগ চাষ করতে চায়। তাই কোনো ভাগচাষী মালিকের সাথে তর্ক করলে জমি হাতছাড়া হতে পারে। এজন্যও অনেকে চুক্তির কথা তোলে না।
বড়রামদেবপুরের এনায়েত বলেন, বর্গাচাষীরা এ এলাকায় এক সময় জমি মালিকদের প্রায় সমান তালে চলতে পারত। দেখা যেত একজন ভাগচাষী কয়েকবার একটি জমি চাষ করছে। কিন্তু বর্তমানে জমি মালিকরা বারবার জমি হাত বদল করছে। বিক্রি করছে। এজন্য ভাগচাষীরা আগামী বছর জমি পাবে কী না ? জমি এ মালিকের কাছে থাকে কীনা এ জাতীয় একটি ভয়ের মাঝে থাকছে।
ভাগচাষের ফলে চাষীরা মূলত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সদর উপজেলার সোন্দলপুর ও চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের কয়েকজন ভাগ চাষী জানান, গ্রামে বৌ-ছেলে নিয়ে থাকি। অন্য সময় বদলা দেই তাই ‘বাগা’ চাষ করি। কিন্তু এ চাষে লাভ নেই।
জমি মালিক ১০ গন্ডা জমি ভাগ চাষে দিলে তিনি কোনো খরচ দেন না। সমস্ত খরচ দিতে হয় ভাগচাষীকে। ১০ গন্ডা জমি হালচাষ ৫০০ টাকা, বীজ ৩০০ টাকা, ঘাস বাছাই ৪০০ টাকা, বীজ উৎপাদন ২০০ টাকা, সার, কীটনাশক ২৫০ টাকা, পানি সেচ ৮০০ টাকা, কাটাই মাড়াই ৩০০ টাকা। অর্থাৎ ১০ গন্ডা জমির পেছনে একজন ভাগচাষীকে প্রায় তিন হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এছাড়াও ভাগচাষী ফসল লাগানো থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩/৪ ঘন্টা করে জমিতে কাজ করে। এ কাজের দাম কখনো হিসাব করা হয় না। কিন্তু ফসল উৎপাদন শেষে ফসল ভাগের সময় যে পদ্ধতিতেই ভাগ করা হোক না কেন ভাগ চাষীর এ শ্রমের অর্ধেক জমি মালিকের কাছে চলে যায়। কিন্তু ১০ গন্ডা জমিতে ধান পাওয়া যাবে ২০ মন। বাজার দর মনপ্রতি ২৫০ টাকা হারে হবে পাঁচ হাজার টাকা। ভাগচাষী পাবে ২৫০ টাকা। তাতে দৃশ্যত লাভক্ষতিতে ভাগচাষীর ৫০০ টাকা ক্ষতি হয়।
আবার জমি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করছে বলে যে জমির দামও কমে যাচ্ছে তাও নয়। তথ্য সংগ্রহকালে দেখা যায়, প্রত্যেক এলাকায়ই যে জমির আগে প্রতি একরের দাম ছিল ৫০ হাজার এখন তা ৬০/৭০ হাজার টাকা হচ্ছে। ফলে জমি মালিককে সে দিকেও ঠকতে হয় না। এ প্রসঙ্গে শোল­া গ্রামের বেলাল বলেন, এত হিসাব করার সময় কৈই? ধান যা পাই তা ভাগ করে দিয়ে দেই। জমি মালিক মাওলানা নুর ইসলাম বলেন, যে চাষ করবে সে তো শ্রম দিবেই এতে হিসাব অথবা ক্ষতির কি আছে।

ভাগচাষের সুফল-কুফল
ভাগচাষের সুফলের কথা বলতে গিয়ে সদর উপজেলার সোন্দলপুর ইউনিয়নের বড়রামদেবপুরের আবুল হোসেন জানান, ভাগচাষের ফলে ধনী কৃষকদের লাভ হয়। একদিকে তাদের কোনো জমি পতিত পড়ে থাকে না। অন্যদিকে নিজেরা জমি চাষ করলে যে ঝুঁকি থাকে ভাগচাষী করলে সে ঝুঁকি তাদের নিতে হয়। ফলে কোনোরূপ খরচাপাতি ছাড়া তারা ফসল পেয়ে থাকে।
তিনি আরো জানান, ভাগচাষের যে প্রথা তাতে চাষীরা উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। দেখা যায়, ভাগচাষীদের পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসলের বিরাট একটি অংশ মালিককে দিতে হয়। এতে ভাগচাষীরা উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
ভাগচাষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় জমির। বড়রামদেবপুরের অলি উল্যাহ বলেন, ভাগচাষের ফলে জমির মান কমে যায়। ভাগচাষী আগামী বছর জমি চাষ করতে পারবে কি পারবে না তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। ফলে জমির কোনো উন্নয়ন করে না। অন্যদিকে ভাগচাষী মনে করে এ বছরই যা ফসল ফলানো যায় তাই লাভ, এ চিন্তা করে জমিতে বেহিসেবে সার কীটনাশক প্রয়োগ করে। ফলে জমির গুণগত মান কমে যায়।

ভাগচাষের সরকারি নীতি
১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অর্ডিন্যান্স (আইন) এ ভাগচাষীদের ¯^v_© সংরক্ষণে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। ভাগ চাষের সংস্কারের জন্য ঘোষিত ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো উলে­খযোগ্য।
১। জমির মালিক ও ভাগচাষীর মধ্যে ন্যূনতম পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য একটি লিখিত চুক্তি থাকবে। এ মেয়াদের মধ্যে ভাগচাষীকে চাষাবাদ থেকে বিরত রাখা যাবে না। তবে চুক্তির শর্ত যদি ভাগচাষী দ্বারা লঙ্ঘিত হয় সে ক্ষেত্রে জমির মালিক ভাগচাষীকে অবশ্যই জমি চাষাবাদ থেকে বিরত রাখবে।
২। কোনো ভাগচাষী ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমি চাষাবাদ করতে পারেন।
৩। মালিক বর্গায় প্রদত্ত জমি বিক্রি করতে চাইলে তা ক্রয়ের সুযোগ প্রথমে ভাগচাষীকে দিতে হবে।
৪। বর্গার প্রদত্ত জমির উৎপাদিত ফসল তেভাগা নীতিতে বন্টন করতে হবে। অর্থাৎ উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশ জমির মালিক, এক তৃতীয়াংশ ভাগ চাষী ও এক তৃতীয়াংশ পাবে উপকরণ সরবরাহকারী। যদি উপকরণ জমি মালিক ও ভাগচাষী যৌথভাবে প্রদান করে তবে ফসল ৫০:৫০ হিসেবে জমি মালিক ও ভাগচাষীর মধ্যে বন্টিত হবে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে ২০ জন কৃষকের সাথে আলাপে ১৭ জন জানান, তারা ভাগচাষে সরকারি নীতি সম্পর্কে জানেন না। তিনজন বলেছেন তারা জানেন কিন্তু জমি মালিকরা যেভাবে বলেন সেভাবে চাষ করতে হয়।

মালিক ও ভাগচাষী দ্বন্দ্ব
সরেজমিন পরিদর্শনে অনেক কৃষক বলেন, জমি মালিক ও ভাগচাষীর মধ্যে বর্তমানে দ্বন্দ্ব খুবই কম। তবে চাটখিলের মোহাম্মদপুর গ্রামের বেলাল বলেন, ফসল ভাগের সময় সাধারণত দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ফসল চাষের সময় জমি মালিকরা কোনো উপরকণ দেয় না। সেগুলো চাষীকেই দিতে হয়। ফলে ফসল ভাগের সময় তিনভাগে ভাগ করার কথা থাকলেও জমি মালিক দু ভাগে ভাগ করে নিজে এক ভাগ নিয়ে যায়। এতে দু পক্ষের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
আবার একই গ্রামের শাহ আলম বলেন, আমি ভাগচাষী। চাষাবাদে তেমন লাভ হয় না। কিন্তু তারপরও চাষ করি ধানের খড়গুলো দিয়ে ঘরের চাল ছানি দিব এ আশায়। কিন্তু জমি মালিক তাও নিয়ে যায়। এ কারণে তার সাথে আমার তর্ক হয়। এরপর থেকে আমি আর ভাগচাষ করি না।

সুপারিশ
সরকারের সংশি­ষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমি মালিক ও ভাগচাষীদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন কিংবা মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা। ভাগচাষীকে জমি চাষে ¯^vaxbZv দেওয়া এবং ভূমি সংস্কার নীতি বাস্তবায়ন করে ভূমিহীন চাষীদের মাঝে খাসজমি বিতরণ করলে ভাগচাষীদের জীবন মানের উন্নয়ন সম্ভব বলে সরেজমিন পরিদর্শনে ভাগচাষী ও জমি মালিকরা জানান।

Sunday, July 29, 2007

হালকাহন

একদিন সন্ধ্যে বেলা আকাশের নীলাভ দেখে

আমার পাখি হতে ইচ্ছে করেছিল। যদি পাখি হতাম তাহলে নীল আকাশে দিনমান ঘুরে
বেড়াতে পারতাম।

একদিন সাতসকালে ঠান্ডা ঝিরঝিরে বাতাস গায়ে মেখে

আমার শিশির হতে ইচ্ছে করেছিল। যদি শিশির হতাম তাহলে ভোরের শীতল শিশির
সূর্যস্নান করতে পারতাম আমৃত্যূ।

আজকে আবার ভিন্ন ইচ্ছে হচ্ছে

যদি মাছি কিংবা কোনো পতঙ্গ হতাম তাহলে তোমার গালের ভয়ংকর সুন্দর টোল'টা ছুঁয়ে
দেখতে পারতাম

কিংবা

যদি পানি হতাম তাহলে তোমার আটপৌঢ়ে আসা যাওয়ায় গাল ধুয়ে নিতে, তাতে যদি
একবারও তোমার টোলের সৌন্দর্য্য আমি পাই তাও-বা কম কিসে।

তবে বৃষ্টি হতে পারলেই ভালো হতো বেলা-অবেলায় তোমাকে ভিজিয়ে দিতাম টোল ছুঁয়ে
দেখবার অজুহাতে।

কিন্তু আমার দরিদ্রভাগ্য

আমি এর কিছু হতে পারলাম না।

তাই বলে কী তোমার আশ্চার্য্য সুন্দর টোল আমার ছুঁয়ে দেখা হবে না।

দুর ছাই, ছুঁয়ে দেখা নাই-বা হলো

তুমি হাসতে থাক আমি তোমার গালের টোল দেখি।

আর কী করব?

অন্তত: ঢোক গিলতে থাকি ॥

Saturday, July 28, 2007

ভূমি সংস্কার নীতি বাস্তবায়নে শম্ভুক গতি

ভূমি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের ক্ষেত্রে দ্বৈত শাসন, অব্যবস্থা ও সমন্বয়হীনতা, মান্ধতার নিয়মে রেকর্ড সংরক্ষণ ও সংশোধন পদ্ধতির ফলে ভূমি সংস্কার নীতি বাস্তাবায়িত হচ্ছে না। গ্রামীণ উন্নয়নকে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু ধরে দারিদ্র্য পীড়িত কৃষি নির্ভর আমাদের দেশের ভূমি সংস্কারের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা ছাড়া দেশের অর্থনীতির আমুল পরিবর্তন সম্ভব নয়।
ভূমি সংস্কার কি? : অর্থনীতিবিদদের মতে ভূমি সংস্কার হচ্ছে ভূমি ব্যবস্থার ত্র“টি সমূহ দূর করে জমির মালিকানা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে ভূমির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের পুরোপুরি স্বার্থ সংরক্ষণ ও দেশের সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নের জন্যে যথাপোযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ভূমির মালিকানার পূণবিন্যাস, মালিক ও প্রজার মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন, জমির খন্ডীকরণ রোধ, খন্ডিত জমিসমূহ একত্রীকরণ এবং কৃষির সাথে যুক্ত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রভৃতি বিষয়গুলোকে ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মূলত এক কথায় বলা যেতে পারে ভূমি সংস্কার হচ্ছে, বিদ্যমান ভূমিস্বত্বের ত্র“টিসমূহ দূর করে দেশের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে যে যথাপোযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাই ভূমি সংস্কার।
ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা: আমাদের মত একটি কৃষি নির্ভর উন্নয়নশীল দেশের জন্যে ভূমি সংস্কার উন্নয়নের পথে একটি মৌলিক বিষয়। কেননা দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং সকলেই কোন না কোনভাবে গ্রাম অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত এবং নির্ভরশীল। নরোত্তমপুর ইউনিয়ন কৃষি ব্লক সুপারভাইজার আব্দুল মতিন বলেন, আমরা ভূমি নির্ভর দেশের মানুষ। যেহেতু গ্রাম অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ভূমি নির্ভর তাই আমরা সকলেই ভূমি নির্ভর। গ্রামীণ মানুষের অধিকাংশ ইতিমধ্যে জমি হারিয়ে ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণ জনসংখ্যার ৬২ শতাংশই এখন ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আর্থ-সামাজিক কাঠামো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অব্যবস্থার কারণে প্রতি বছর এ সংখ্যা আরো বেড়েই চলেছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৪০ আসে কৃষি থেকে তথা ভূমি থেকে। তাছাড়া মোট শ্রম শক্তির ৭২ ভাগই কৃষি উৎপাদন তথা ভূমিতে নিয়োজিত। তাই এ সকল বৈষম্য ও দারিদ্র্যতার চিত্র পরিবর্তন করতে হলে ভূমি সংস্কার করা অত্যাবশ্যক বলে আবদুল মতিন জানান।
ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যে সকল লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে: অর্থনীতিবিদের অভিমত, প্রান্তিক কৃষক, সাধারণ মানুষ ও পেশাজীবিদের সাথে আলাপ করে ভূমি সংস্কার যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ভিতর দিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যগুলো অর্জিত হতে পারে বলে জানা যায় সেগুলো হলো: ১। কৃষি উৎপাদন ও জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ২্। ভূমির যথাযথ ব্যবহার এবং স্থায়ী ব্যবহার যোগ্যতার নিশ্চয়তা সৃষ্টি ৩। ভূমি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সম্পদ খাল, বিল,জলাশয়, জনমহল, পুকুর ইত্যাদি সুষ্ঠু ব্যবহারের নিশ্চয়তা সৃষ্টি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। ৪। ভূমিহীন (সব ভূমিহীন পরিবারকে ভূমি দেওয়া সম্ভব নাও হয়) প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের হাতে চলে আসা জমি ও সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি, ফলে তাদের উৎসাহ, উদ্যোগ দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পরিণামে উৎপাদন বৃদ্ধি। ৫। প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং অন্যান্য সুবিধা প্রান্তিক ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষকদের নাগালের মধ্যে আসা যার ফলশ্র“তিতে তাদের উদ্বুদ্ধ ও সঞ্চয় বৃদ্ধি। ৬। এ সকল উদ্ধুত্ত ও সঞ্চয় অকৃষিজ নানা উৎপাদনশীল উদ্যোগ ও গ্রাম ভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগের বাস্তব সম্ভাবনা তৈরী। ৭। গ্রামীণ দরিদ্র বেকারদের কর্মসংস্থান/আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ৮। গ্রামীণ দরিদ্রদের ব্যাপকাংশের জীবনমান উন্নয়ন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া রোধ।
ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যে সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক সুফল অর্জিত হতে পারে: (ক) সমাজে ভূমিকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে যে সব হানাহানি মারামারি, মামলা-মোকদ্দমা, খুনাখুনি ঘটে আসছে তা হ্রাস পাবে এবং পরিণামে ভূক্তভোগীদের অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ অপচয় থেকে রক্ষা পাবে। (খ) বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর যে চরম ভারসাম্যহীনতা ও বৈষম্য রয়েছে তা হ্রাস প্রাপ্তি ও স্থানীয় উন্নয়মূলক প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগের সাথে ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ কর্মকান্ডে সমষ্টিগতভাবে অংশগ্রহণের ফলে বৃহত্তর জনগোষ্টীর সংহতি চেতনা বৃদ্ধি, সমষ্টিগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উন্নয়নে তার ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি। (ঘ) উৎপাদনমুখী ও সামাজিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং এপথে বিদ্যমান সামাজিক বাধাগুলো দ্রুত বিলুপ্তি। (ঙ) ভূমি সংস্কারের বাস্তবায়নে স্থানীয় স্বশাসিত সরকারের সম্পৃক্ত করার ভিতর দিয়ে স্বশাসিত সরকার কাঠামো আরও গতিশীল, অংশগ্রহণমূলক ও জনগণের কাছে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিতামূলক হয়ে উঠবে। (চ) ভূমি একটি বহুমাত্রিক কর্ম। তাই এর বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ সামাজিক ফলাফল হিসাবে উৎপাদনে ব্যাপক গণউদ্যোগ সৃষ্টি, গণশিক্ষায় নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, সামাজিক পরিবেশ, গণস্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, রোগ ও মহামারী প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি। (ছ) গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্টীর ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে তা ব্যাপক শিল্পায়নের সহায়ক হবে।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ভূমি সংস্কার: ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর থেকে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যবস্থা গৃহিত হয়েছিল। এতে কৃষি উন্নয়নের পথ কিছুটা হলেও প্রশস্ত হয়েছিল। কিšদ কৃষির উন্নয়নে যে বিপ্লব গঠিত হওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল তা প্রকৃতপক্ষে হয়নি। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ সরকার কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এ লক্ষ্যে ১৯৭২ ভূমি সংস্কার। ১৯৭২ সালের ভূমি সংস্কার নীতির বিশেষ দিক সমূহ হলো: ১। খাজনা মওকুফ: দরিদ্র কৃষকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকার ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সকল বকেয়া খাজনা সুদসহ মওকুফ করে দিয়েছেন। ঐ একই দিন হতে ২৫ বিঘার কম জমির খাজনা মওকুফ করে দেওয়া হয়। ২। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ: সরকার জমির সর্বোচ্চ মালিকানা পরিবার প্রতি ১০০ বিঘায় নির্দিষ্ট করে দেন। তবে ফলের বাগান, চা বাগান ও ডেইরী ফার্মের ক্ষেত্রে জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা শিথিলযোগ্য থাকবে।৩। জমি বন্টন: নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ সীমার অধিক উদ্বুদ্ধ জমি ভূমিহীন কৃষক, নদী ভাঙনে ছিন্নমূল ও প্রান্তিক কৃষকদের (যাদের ১.৫ একরের কম জমি রয়েছে) মধ্যে বন্টনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।৪। ইজারাদারী প্রথার বিলোপ: দীর্ঘকাল যাবৎ বাংলাদেশে নির্যাতনমূলক ইজারাদারী প্রথা প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশ সরকার এ প্রথার বিলোপ সাধন করেন।৫। অনাবাদী জমি চাষের বিশেষ কর্মসূচি: অনাবাদী জমি চাষের জন্যে সরকার এ নীতিমালার এক বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।৬। পৃথক মন্ত্রণালয় স্থাপন: দেশের ভূমি স্বত্ত্ব ব্যবহার দ্রুত সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে সরকার ‘ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার’ নামক একটি পৃথক মন্ত্রণালয় স্থাপন করেছেন।১৯৮২ সালর জুলাই মাসে ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি ভূমি সংস্কার কমিটি গঠন হয়। এ কমিটি ১৯৮৩ সালের জানুয়ারী মাসে ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরকারের নিকট বিভিন্ন সুপারিশ পেশ করেন। এ সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্যে সরকার ভূমি সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ১৯৮৪ জারি করেন। এ ভূমি সংস্কার নীতি ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার নীতি নামে পরিচিত। ১৯৮০ সালের ভূমি সংস্কার নীতির উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিুরূপ: ১। পরিবার প্রতি জমি সর্বোচ্চ মালিকানা ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবং তা কোন অবস্থাতেই পরিবর্তন করা হবেনা। ২। যাদের জমি বর্তমানে ৬ বিঘার নীচে রয়েছে ক্রয়ের মাধ্যমে তা ৬০ বিঘার উর্ধ্বে নেওয়া যাবেনা। ৩। বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত এরূপ জমি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা যাবেনা। বসতবাড়ি নির্মাণ করার মত খাসজমি থাকলে সরকার বা ভূমিহীন ও শ্রমিকদের মধ্যে বন্টন করবেন। ৪। বিনা চুক্তিতে কেউ অন্যের জমি চাষ করতে পারবেনা। বর্গাচুক্তি ৫ বছরের জন্যে স্থায়ী হবে। ৫। কোন বর্গাকার ১৫ বিঘার অধিক জমি বর্গা শর্তে রাখতে পারবেনা। ৬। মালিক বর্গায় প্রদত্ত জমি বিক্রি করতে চাইলে তা ক্রয়ের প্রথম সুযোগ বর্গাদারকে দিতে হবে। ৭। বর্গায় প্রদত্ত জমির উৎপাদিত ফসল তেভাগা নীতিতে বন্টন করতে হবে। অর্থাৎ উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশ মালিক, এক তৃতীয়াংশ বর্গাদার ও এক তৃতীয়াংশ মালিক বর্গাদার উৎপাদনের উপাদানের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে পাবে। ৮। কৃষি মজুরদের ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩.৫ সের (৩.২৭ কেজি) চাল। ৯। জমির মালিক ও বর্গাচাষী যে ক্ষেত্রে সমভাবে সকল কৃষি উপকরণ সরবরাহ করবে সেক্ষেত্রে ফসল ৫০:৫০ হিসেবে মালিক ও বর্গা চাষীর মধ্যে বন্টিত হবে। ১০। নতুন চর এলাকায় পাওনাযোগ্য জমি ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের মাঝে বন্টনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১১। গ্রামীণ এলাকায় উৎপাদন ও সংগঠন কাঠামোকে ন্যায়ধর্মী করে তোলার উদ্দেশ্য সামনে রেখে খাস কৃষি জমি কেবলমাত্র ভূমিহীন বা প্রায় ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্দোবস্ত দেওয়া যেতে পারে। ১২। গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী কৃষকদের ঋণের দায়ে বা¯দভিটা থেকে উচ্ছেদ করা যাবেনা।্এছাড়াও ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ৫০০০/- টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ সুদসহ এবং ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফ করেন। ভূমি সংস্কার নীতি এ যাবতকাল পর্যন্ত যেভাবে গৃহিত হয়েছে তাতে গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসনের পথ প্রশস্ত হয়নি। প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষুদ্র কৃষকে এখনও ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে। নানাভাবে হচ্ছে নিগৃহীত।
সরকার গৃহিত ভূমি সংস্কারের ফলাফল: বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সাল এবং ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন তা কতটুকু কার্যকরী হয়েছে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের জেলা যুগ্ন আহবায়ক আবদুল মমিন বিএসসি বলেন, জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করা হলেও উদ্বুত্ত জমি সরকারের হাতে আসেনি। তাছাড়া ভূমি বন্টনের ক্ষেত্রে এখন নাগাদ কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে ভূমিহীনদের সংখ্যা না কমে ক্রমশঃ বেড়েই চলছে। তাছাড়া সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করলেও শিক্ষা কর, সেচকর ইত্যাদি কর মওকুফ করেনি। ফলে কৃষকরা লাভবান হতে পারেননি। এগুলো নীতিমালার ব্যর্থতা হলেও পাশাপাশি কিছু সফলতা আছে বলেও তিনি জানান, বর্গাদারের স্বার্থ সম্পর্কে তিনি বলেন, উৎপাদিত ফসল কিভাবে মালিক ও বর্গাদারদের মধ্যে বন্টিত হবে সে বিষয়টি নির্ধারণ হওয়ায় সে সমাধান হয়েছে। ন্যুনতম কৃষি মজুরিও নির্ধারণ হয়েছে। তবুও যে সকল লক্ষ্য সামনে রেখে ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্য তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বলেও তিনি জানান।
ভূমি সংস্কার নীতি ও বর্তমান অবস্থা: স্বাধীনতা লাভের পরে দুইটি ভূমি সংস্কার নীতিমালা প্রণয়ন হলেও সাধারণ কৃষকদের তথা ক্ষুদ্র প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে তা পুরোপুরি সহায়ক হতে পারেনি বলে অনেকে মন্তব্য করে। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে বাটইয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শেখ আহম্মদ ভূঞা বলেন, জমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা ১০০ বিঘা নির্ধারণ এবং পরবর্তীকালে তা কমিয়ে জমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা ৬০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়। জমির সর্বোচ্চ সীমা এভাবে নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিরাজমান ধনবৈষম্য হ্রাস পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়নি। জমির সর্বোচ্চ সীমা ২৫ বিঘা থেকে ৪০ বিঘার মধ্যে ধার্য করলে গ্রামাঞ্চলে ধনবৈষম্য হ্রাস পেত এবং সাধারণ কৃষকদের অবস্থার উন্নতি হতো। ভূমি সংস্কার পদক্ষেপে উদ্বুত্ত জমি ক্ষুদ্র প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিšদ জমির সর্বোচ্চ মালিকানা ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করায় বন্টন করার মত পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত জমি সরকারের হাতে আসা সম্ভব নয়। ১০০ বিঘা জমি পরিবার প্রতি রাখার পর মাত্র ১২ লক্ষ একর উদ্বৃত্ত জমি সরকারের হাতে আসবে। সরকারের হাতে রয়েছে ৪ লক্ষ একর খাস জমি। বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ১৪ লক্ষ। মাথাপিছু অর্ধ একর জমির রয়েছে এমন কৃষকের সংখ্যা ১৬ লক্ষ। এ সকল কৃষকও মূলত ভূমিহীন। মাত্র ১৬ লক্ষ একর জমি ৩০ লক্ষ কৃষকের মধ্যে বন্টন করলে প্রত্যেকে অর্ধ একরের মত জমি পাবে। এমতাবস্থায় কৃষকদের প্রকৃত অবস্থার মৌলিক কোন পরিবর্তন না হওয়াই স্বাভাবিক।এক জরিপ থেকে দেখা যায় যে, মোট আবাদী জমির শতকরা ২৫ ভাগ মাত্র ২ শতাংশ লোকের মালিকানায় রয়েছে। পক্ষান্তরে শতকরা মাত্র ৪.৮ ভাগ জমি রয়েছে ৫০ ভাগ চাষীর মালিকানায়। বর্তমানে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৬০জন। গ্রামীণ এলাকার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা অভাবের তাড়নায় তাদের শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে। আর মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ভূমি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
ভূমি সংস্কারের বাস্তবতা: আমাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম। তাই সংগতিপূর্ণ সংস্কার করতে হলে দেশের সিলিং অনেক নীচে নামাতে হবে। ফলে ধনী এমনটি মধ্যম শ্রেণীর কৃষকদের একটি অংশ ও সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। তবুও যে জমি পাওয়া যাবে তা দেশের বিপুল গ্রামীণ জনগণের প্রত্যেকের মাঝে দেওয়াও অসম্ভব হয়ে উঠবে। তবুও যদি তা দেওয়া হয় তাতে অনেক অ-অর্থনৈতিক ক্ষুদ্রজোতের জন্ম হবে। আর যদি ভূমিহীনদের নয় কেবল যাদের জমি আছে তাদের দেওয়া হয় তাহলে গ্রামের ভূমিহীনরা সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের অভিমত হল, ভূমি সংস্কারের মূলভিত্তি হচ্ছে ‘গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতা কাঠামোকে ভেঙ্গে সেখানে একটি সমতা বিমুখী প্রবৃদ্ধির সুচনা ঘটানো।’
ভূমি সংস্কারের জন্যে যা করা যেতে পারে: রেকর্ড সংরক্ষণ ও সশোধন পদ্ধতির ভুলের জন্যে মালিকানা নিয়ে জটিলতা একাধিক দাবীদারের জন্ম এবং জালিয়াতির ও প্রতারণার সুযোগ রয়েছে। রেকর্ড সংরক্ষণ ও সংশোধন পদ্ধতির আধুনিকীকরণ ও উল্লেখিত অবস্থা ও সমন্বয়হীনতা দূর করা ভূমি প্রশাসন সংস্কারের একটি মৌলিক ও জরুরী করণীয় বলে গণ্য করা উচিত। আর এস রেকর্ডের বিষয়টি একটি চালমান প্রক্রিয়া। তবুও এ প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান ত্র“টি ও জটিলতার জন্যে জনগণের কষ্টের অন্ত নেই। তাই সিএস এবং এস এ রেকর্ডের তথ্যাদি ম্যাপ পর্চা এসকল বিষয়গুলো সংরক্ষনে আধুনিকায়ন করা উচিত বলে তিনি জানান। ভূমি আইনের সংস্কার ভূমি সংস্কারের মৌলিক লক্ষ্যে পৌছার জন্যে অত্যাবশ্যক। বর্তমান আইনগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে এ আইনটি পর্যালোচনা করা উচিত। তাতে এ আইনটি থেকে প্রয়োজনীয় অংশ বাতিল করে সমযোপযোগী করা উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির স্বার্থেই অপরিহার্য।ভূমি সংস্কারের বড় কাজগুলোর মধ্যে আরো ভাবনার যা তা হচ্ছে ভূমি নিয়ে বিচার পদ্ধতির কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার। খাস জমি, চরের জমি, বন, জলা, বিল, জলমহল, জাল দলিলের ভিত্তিতে রুজু করা টাইটেল সুট-এ জাতীয় মামলা যার সঙ্গে অনেক মানুষের ভাগ্য ও স্বার্থ জড়িত। তা দ্রুত নিষ্পতির জন্যে ভূমি ট্রাইবুনাল গঠন করা যেতে পারে।১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশে বর্গাচাষীদের অধিকার সংরক্ষণের কিছু বিধান চালু আছে। তবুও এ নিয়ম বাস্তবায়নে কিছু জটিলতা আছে। এ জটিলতা দূর করে আইনটিকে বাস্তবায়ন যোগ্য করা উচিত বলে অনেকেই মতামত দেন। বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির শতকরা কতভাগ অনুপস্থিত মালিকদের মালিকানায় আছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে ভূমির সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করার জন্যে এ অনুপস্থিত মালিকানা নিষিদ্ধ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে মাহবুবুল আলম দুলাল বলেন, অনেক বিধবা, ক্ষুদ্র দোকানী, স্কুল শিক্ষক, কেরানী অফিসের দারোয়ান, পিয়ন, কারখানা শ্রমিক ইত্যাদি পেশার মানুষ অনুপস্থিত মালিক শ্রেণীভুক্ত হলেও নিজের ও পরিবারের জীবন ধারণের জন্যে নির্দিষ্ট জমির উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে অনুপস্থিত মালিকানা তুলে দেবার আগে তাদের স্বার্থের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।

Monday, July 16, 2007

গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থা সংকটে

নোয়াখালী জেলার সুধারামে প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রয়োজনীয় শিক্ষক, শ্রেণী কক্ষ ও আসবাবপত্রের অভাব এবং শিবিখা কর্মসূচিতে দুর্নীতি ও পরিচালনা কমিটির দায়িত্বহীনতার কারণে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। নোয়াখালী সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনসাধারণ, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক, এনজিও কর্মী, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সাথে আলাপকালে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সরকার ১৯৯০ সালের ১৩ ফেব্র“য়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক আইন পাশ করে। ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে এ কর্মসূচি একযোগে চালু হয়। এ আইনের মাধ্যমে ৫ থেকে ১১ বছরের শিশুদের বিদ্যালয়ে গমন বাধ্যতামূলক করা হয়। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা যাতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় সে জন্য সরকার শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করে। সরেজমিন আলাপে অনেকে অভিমত দেন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা একটি কাগুজে ঘোষণা। সরকার প্রয়োজনীয় উপকরণ, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট দারিদ্র্যের জন্য সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে পারছে না বলে সাধারণ মানুষের ভাষ্য থেকে জানা যায়। তবে এ প্রসঙ্গে কবির হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইকতেয়ার উদ্দিন বলেন, শিক্ষা সংস্কারের জন্য নানা কর্মসূচির সাফল্য প্রবক্তাদের আশানুযায়ী কখনোই অর্জন সম্ভব হয়নি। গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি রেজিষ্টার্ড, নন রেজিষ্টার্ড, মক্তব, হাফেজিয়া ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসা এবং উপানুষ্ঠানিকসহ চতুমাত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে।
যা সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কাম্য নয়
প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিটি শিশুর জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বুনিয়াদি শিক্ষা নিশ্চিত করে এবং পরবর্তীকালে জীবন ধারণের ভিত্তি রচনা করে।
প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে এমসিসি (ম্যানোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি) বানদত্ত শাখার ব্যবস্থাপক যুগল কিশোর দাস বলেন, তুরস্ককে এক সময় ইউরোপের রুগ্ন দেশ বলা হত। অথচ ব্রিটিশ শাসনের পর মাত্রা বিশ বছরের মধ্যে তুরস্কের শিক্ষার হার দাঁড়িয়েছে শতকরা ৬০-এ। ফলে সে দেশের অর্থনেতিক চিত্রের বদল হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের ত্রিশ বছর পরও আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় বহু সমস্যা বিদ্যমান বলেও তিনি জানান।
সরেজমিন পরিদর্শন ও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে আলাপকালে জানা যায়, সীমাহীন অনিয়ম ও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে সুধারাম থানার প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। সরকার বিদেশী ফর্মূলা মোতাবেক আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ক্যারিকুলাম চালু করলেও সে অনুপাতে শিক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারেনি। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও আসবাবপত্রের স্বল্পতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রায় প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে চেয়ার, টেবিল ও ছাত্রছাত্রীদের বসার বেঞ্চের অভাব লক্ষণীয়। একটি লম্বা বেঞ্চে তিনজন ছাত্রছাত্রী বসার কথা থাকলেও সেক্ষেত্রে চার/পাঁচ জন করে ছাত্রছাত্রী বসে। ফলে স্বাভাবিক পাঠদান যেমন ব্যাহত হয় তেমনি গাদাগাদি করে বসার ফলে অনেক ছাত্রছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে বলে জানা যায়।
শিক্ষক স্বল্পতাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি বড় সমস্যা। বিদ্যালয় সমূহে ৬০ঃ১ অনুপাতে শিক্ষক থাকার নিয়ম থাকলেও কোনো বিদ্যালয়েই সে অনুপাতে শিক্ষক নেই। বানদত্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক দরকার আট জন। কিন্তু শিক্ষক রয়েছে পাঁচ জন। ফলে প্রয়োজনীয় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা বেবী রানী পাল বলেন, আমরা সবাই মিলে বিরতি ছাড়া এক নাগাড়ে ক্লাস নিলে পাঠদানের সমস্যা সমাধান করা যায়। কিন্তু আমাদের যে পরিমাণ সরকারি কাজ করতে হয় সেগুলো করতে হিমশিম খেয়ে যাই। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির তালিকা তৈরি, বিভিন্ন ধরণের চারুকারুর কাজ ও সরকারি অন্যান্য কাজ করতে একজন শিক্ষককে পুরোমাস অফিসে বসে থাকতে হয়। ফলে একজন শিক্ষক মত ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও ক্লাস নিতে পারেন না বলে তিনি জানান।
মাকু চৌধুরী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ হানিফ বলেন, শিক্ষকদের ওপর ম্যানেজিং কমিটির প্রভাব শিক্ষা কার্যক্রমেরএকটি অন্তরায়। বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের অনেক সদস্য গম পাওয়ার অযোগ্য অনেক ছাত্রছাত্রীদের কার্ড দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের অবৈধভাবে চাপ দেয় অথবা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। ফলে কোথাও কোথাও শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। এ সকল দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষা ব্যাহত হয় বলে তিনি জানান।
গ্রামের অনেক শিক্ষকের শিক্ষকতা ছাড়াও অন্য পেশায় জড়িত থাকতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে হাজির হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, শিক্ষকদের যে বেতন ভাতা দেওয়া হয় তাতে অনেক শিক্ষক সংসারের খরচের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। ফলে শিক্ষকরা অন্য পেশায় জড়িত হয়।
প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলেও গ্রামাঞ্চলের অনেক শিশু বিদ্যালয়ে আসে না। নরোত্তমপুর ইউনিয়নের ফলাহারী গ্রামের অভিভাবক আবুল খায়ের মিয়া বলেন, শিশুদের বিদ্যালয়ে না আসার প্রধান কারণ দারিদ্র্য এবং অভিভাবকদের মাঝে মান্ধাতার আমালের ধারণা। অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নিজের কিংবা অন্যের শ্রমে নিয়োজিত করে। পড়ালেখা শিখিয়ে কি লাভ, এ ধারণা পোষণ করে অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠায় না। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য সম্পর্কে আবুল খায়ের মিয়া বলেন, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্প চালু হওয়ায় বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদেরও নৈতিকতার মৃত্যু ঘটেছে। কারণ এ প্রকল্প চালু হওয়ায় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদের মধ্যে দুর্নীতি আশ্রয় নিয়েছে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের গম কিংবা উপবৃত্তি না দিয়ে তাদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে সুপারিশ করেন। আগের তুলনায় বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান সবদিক দিয়ে ভালো বলে মন্তব্য করেন অশ্বদিয়ার বদরপুর গ্রামের আসাদুজ্জামান চৌধুরী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপকরণের অভাব, শিক্ষক স্বল্পতা, শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলা এবং কিছু শিক্ষকের দক্ষতার অভাব থাকায় শিক্ষার মান কমছে। প্রাথমিক স্তরে গ্রাম ও শহর এবং সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার বিদ্যমান সমস্যাসমূহ সমাধান করলে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষার মান আরো উত্তোরত্তর সমৃদ্ধি পাবে।

রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়
গ্রামীণ শিক্ষার উন্নয়নে সরকার গ্রামভিত্তিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করার ফলে গ্রামাঞ্চলে অনেক রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সরেজমিন দেখা যায় রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা খুবই নাজুক। মাকু চৌধুরী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ হানিফ বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী প্রায় ২০০ জন। অথচ আমরা দু’জন শিক্ষক। ফলে এত ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। তাছাড়া প্রতিদিন হাজিরা খাতা এবং চক পেন্সিলসহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় শিক্ষা সরঞ্জাম আমি ব্যাগে করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসি। কারণ বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রখার ব্যবস্থা না থাকায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাড়িতে রাখতে হয়। বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের বসার জন্য প্রয়োজনীয় বেঞ্চ নেই। শিক্ষকদের কোনো অফিস কক্ষে বসার জন্য কোনো আসবাবপত্র নেই। বিদ্যালয় গৃহের টিনের চাল থাকলেও চারপাশে কোনো বেড়া কিংবা আলাদা কোনো শ্রেণী কক্ষ নেই। এ বিদ্যালয়ের দৈন্যদশার কারণে গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে আসে না বলে তিনি জানান। শিশুরা সব সময় চাকচিক্য, নতুনত্ব এবং সুন্দর জিনিস চায়। কিন্তু শিশুরা নিজের গ্রামের বিদ্যালয়ের এ করুণ অবস্থা দেখে শিক্ষার প্রতি অনাসক্ত হয়ে পড়ে বলে জানান সোন্দলপুর ইউনিয়নের পুর্ব রাজুরগাঁও গ্রামের মাহবুবুল হক চৌধুরী। রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সবিতা প্রভা শীল বলেন, রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারের সাহসী পদক্ষেপ। গ্রামীণ শিক্ষার উন্নয়নে এ বিদ্যালয়গুলোর আরো উন্নয়ন করা উচিত। তিনি বলেন, আমরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সমান শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদান করলেও তাদের সমান বেতন ভাতা এবং সম্মান পাই না। তিনি আরো জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঝে সুযোগ সুবিধা এং শিক্ষকদের বেতন ভাতা প্রদান সংক্রান্ত বৈষম্য দূর করলে গ্রামীণ শিক্ষা আরো অগ্রগতি লাভ করবে।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা
যারা সরকারি বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না অথবা ভর্তি হয়েও বিদ্যালয় ত্যাগ করে অথবা তাদেরকে শিক্ষার মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষিত ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে দেশে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
সোন্দলপুরের রামদেবপুর গ্রামের আবদুল মোল্লা বলেন, বেসরকারিভাবে পরিচালিত বিদ্যালয়গুলো গ্রামের মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে অনেক ভূমিকা রাখছে।
বড় রামদেবপুরে এনআরডিএস পরিচালিত উপানুষ্ঠানিক কেন্দ্রের শিক্ষিকা মোস্তারী বেগম বলেন, গ্রামের অভাবী এবং বিদ্যালয় ত্যাগী শিক্ষা বিমুখ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে শিক্ষিত করে তুলতে আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করি। তবে আমরা এত পরিশ্রম করা স্বত্ত্বেও সংস্থা থেকে প্রদত্ত আমাদের পারিশ্রমিক অতি নগন্য। তিনি শিক্ষকদের পারিশ্রমিক বাড়ালে পাঠদানের শিক্ষকদের মনোনিবেশ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে জানান।

মাদ্রাসা শিক্ষা
গ্রামের অনেক অভিভাবকই ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে তাদের ছেলেমেয়েদের আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আগ্রহী। এতে সন্তানরা যেমন শিক্ষিত হবে তেমনি অভিভাবকদের ইহকাল ও পরকালের পূণ্য আদায় হবে। নরোত্তমপুর ইউনিয়নের ফলাহারী গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শুধুমাত্র আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত হতেই পাঠান না। তারা তাদের সন্তানদের সুযোগ্য নাগরিক তথা আদর্শ চরিত্রবান ও উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে মাদ্রাসায় পাঠান। গ্রামীণ শিক্ষার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাও অন্যতম ব্যবস্থা। ইবতেদায়ী স্তরই হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষার ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রাথমিক বিদ্যালয় সমমানের এ মাদ্রাসাগুলোর কোনো কোনাটিতে মাত্র দু’তিন জন শিক্ষক দ্বারা ছয়/সাতটি বিষয় পড়ানো হয়। সেই সাথে মাদ্রাসার পরিবেশ, পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ, আসবাবপত্র ও অবকাঠামোগত যথেষ্ট সমস্যা আছে। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা শিক্ষকদের মাঝে। অনেক শিক্ষকই হীনমন্যতায় ভোগে। সমশিক্ষিত যোগ্যতা নিয়ে অন্যরা উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষকতা করে বলে অনেকেই নিজেদের ইবতেদায়ী মাদ্রাসার অনেক শিক্ষক তাদের অবস্থানকে অসম্মানজনক ও বেমানান বলে হীনমন্যতায় ভোগেন বলে রামেম্বরপুর এবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্যাহ বলেন।
মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক বিষয়ে সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও উন্নয়ন সাধন। কিন্তু গ্রামের অনেক ইবতেদায়ী, হাফেজী মাদ্রাসা ও ফোরকানিয়া মক্তবে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানের চেয়ে কায়িক শ্রমই বেশি করিয়ে থাকেন। ছাত্রছাত্রীরা মাদ্রাসায় পড়তে গিয়েও দেখা যায় মাদ্রাসার সবজি বাগানসহ অনেক কাজ করতে হয়। দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার অন্য একটি ধারা হল হিফজ। যে সকল মাদ্রাসায় এ হিফজ শিক্ষা দেওয়া হয় সে সকল প্রতিষ্ঠানকে হিফজখানা বা হাফেজী মাদ্রাসাও বলে। এ শিক্ষাক্রমের বর্ষভিত্তিক কোনো সুনির্দিষ্টতা থাকে না। এ সকল প্রতিষ্ঠান কোনো বোর্ডের আওতাভূক্ত নয়। মূলতঃ সম্পূর্ণ ব্যক্তির দান অনুদানের ওপরই এগুলো পরিচালিত হয়।
মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য সরকারের বাৎসরিক ব্যয় থাকলেও গ্রামের অনেক মাদ্রাসা তেমন কোনো সরকারি সাহায্য পান না বলে একজন মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন। অভিভাবকগণের দেওয়া সামান্য অর্থকড়ি ও বিভিন্ন ব্যক্তির দান অনুদানেই মাদ্রাসা চলে। কিন্তু যখনই দাতারা তাদের সাহায্য বন্ধ করে দেন তখনই মাদ্রাসাগুলোর অপমৃত্যু ঘটে বলে অধিকাংশ অভিভাবক জানান।
শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্রামীণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ছে। বিভিন্ন গ্রামে বর্তমানে মেয়েদের জন্য মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে এখনো যথেষ্ট সেকেলে প্রথার প্রচলন রয়েছে। বড়রামদেবপুরে ইউসুফ বলেন, আমাদের গ্রামীণ শিক্ষাও একটি ছকে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। অনেক অভিভাবক কোরআন শরীফ ও নামাজ শেখা ছাড়া মেয়েদের অন্য কোনো শিক্ষার কথা বিবেচনা করেন না।
গ্রামাঞ্চলের ফোরকানিয়া মাদ্রাসাও গ্রামের মানুষের দান খয়রাতে চলে। অনেক আগে যেখানে সেখানে ফোরকানিয়া মাদ্রাসা গড়ে উঠতে যেমন দেখা যায় তেমনি আবার সেগুলো বন্ধ হয়ে যেতেও দেখা যায়। সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের সাধারণ শিক্ষার চেয়ে আরবি শিক্ষা দিতে বেশি আগ্রহী হন। কিন্তু সেখানেও সমস্যা রয়েছে। কবির হাট সিনিয়ার মাদ্রাসার শিক্ষক ওবায়েদ উল্যাহ বলেন, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় সুষম ও সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে কোনো কোনো এলাকায় একাধিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আবার কোনো কোনো এলাকায় কোনো মাদ্রাসা নেই।
ধর্মীয় ভাবাপন্ন ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ায় আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার চাহিদা রয়েছে। তবে গ্রামে গড়ে ওঠা মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা, শিক্ষাদান পদ্ধতিতে ত্র“টি রয়েছে। সমস্যা রয়েছে পরিচালনা পদ্ধতিতেও। অনেক মাদ্রাসায় দেখা গেছে দু’একজন ব্যক্তি নিজ খেয়াল খুশিমতো মাদ্রাসা পরিচালনা করেন। তাই মাদ্রাসাগুলো সঠিক উদ্দেশ্যে ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তুলতে পারছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে নিয়োজিত হয় শিশু শ্রমে।
গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষা
গ্রামীণ জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য শহরের তুলনায় গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থায় সুযোগ সুবিধা অপ্রতুল। গঙ্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জোবেদা কামরুন নাহার বলেন, গ্রামের তুলনায় শহরের শিক্ষার সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা রাস্তাঘাট না থাকায় বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। অথচ শহরের ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্য আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা থাকে। কবিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সহসভাপতি মফিজ উল্যাহ বলেন, গ্রামে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, শিক্ষা সরঞ্জামও নেই, আবার ওপরের শ্রেণীতে ছাত্র থাকলেও ভালো শিক্ষক নেই। ব্যবহারিক ক্লাসের ব্যবস্থা নেই। অথচ শহরের বিদ্যালয়গুলোতে এ সকল সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত। ফলে মেধা থাকা স্বত্ত্বেও গ্রামের ছেলেরা মেধার সঠিক সুষ্ঠু বিকাশ ঘটাতে পারে না।
গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানসমূহে সাধারণত ভাল শিক্ষক পাওয়া দুস্কর। ভাল শিক্ষকরা গ্রামের বিদ্যালয়ে আসতে চান না বলে জানান, ফলাহারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সেতারায়ে ফেরদাউস। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করলেও অনেক শিক্ষক শহরে থাকেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা করানোর চেয়ে শহরের স্কুলে বদলী হওয়ার জন্য অনেক শিক্ষক মহলে তদবিরে ব্যস্ত থাকেন বলে মন্তব্য করেন বড় রামদেবপুর গ্রামের মোঃ আমিন উল্যাহ মিয়া।
গ্রামের প্রায় স্কুলের দালানই পুরনো কিংবা জরাজীর্ণ কাঁচা টিনের ঘর। শিশুরা সর্বদা চাকচিক্য কিংবা নতুনত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু গ্রামের কর্দমাক্ত মাঠ, কাঁচা ঘর কিংবা কোথাও কোথাও মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ক্লাস করতে গিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অথচ শহরে প্রতিটি বিদ্যালয়ই রয়েছে মনোরম পরিবেশ ও সুরম্য দালান। সরকরি বই বিতরণের সময় গ্রাম ও শহরের বিদ্যালয়সমূহের মাঝে পার্থক্য লক্ষণীয়। কবিরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তণ শিক্ষক লুৎফুর রহমান বলেন, শহরের বিদ্যালয়গুলো জানুয়ারি মাসের মধ্যে বই বিতরণ করতে পারে। অথচ গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে বই পেঁৗঁছাতে বছরের কয়েক মাস কেটে যায়। ফলে গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যক্রম শেষ করতে পারে না।
বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যালয় ও কিন্ডার গার্টেন প্রতিষ্ঠা হওয়ায় অনেক অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চায়। চাপরাশিরহাট ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামের রোকেয়া বেগম বলেন, কিন্ডার গার্টেনসমূহের লেখাপড়ার মান ভাল। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের কেয়ারটেকিং চমৎকার। যা ছাত্রছাত্রীদের জীবন গঠনে খুবই সহায়ক। এজন্য অভিভাবকরা এ সকল বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াতে আগ্রহী।
তাছাড়া শহরে ছেলেদের জন্য আলাদা কিংবা মেয়েদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এ জাতীয় বিদ্যালয় নেই বললেই চলে। ঘোষবাগের মিজানুর রহমান বলেন, গ্রামের অনেক অভিভাবক তার মেয়েকে কম্বাইন্ড স্কুলে পড়াতে চান না। কিন্তু আলাদা গার্লস স্কুলের সুবিধা থাকলে হয়ত তার মেয়েকে পড়াতেন। এ সকল দিক বিবেচনা করে গ্রামীণ শিক্ষাকে আরো এগিয়ে আনতে প্রয়োজনে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন ছাদুল্লাপুর গ্রামের দিদার মিয়া।

গ্রামীণ শিক্ষা ও নারী
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামী, সামাজিক কুসংস্কার, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে নারীদের সর্বদা ঘিরে রেখেছে। নারী শিক্ষাকে শুধু পারিবারিক মঙ্গল, শিশু যতœ এবং ঘর কন্যার কাজে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। সরেজমিন দেখা যায়, আমাদের গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন, মেয়েরা যত শিক্ষিত হোক তাদের কাজ ঘরের মাঝে সীমাবদ্ধ।
বাটইয়া গ্রামের মুনাফ মিয়ার পাঁচ সন্তান। তিন জন ছেলে দুই জন মেয়ে। তিনি ছেলেদের স্কুলে পাঠান কিন্তু মেয়েদের পাঠান না। মেয়েদের না পাঠানোর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অভাবের সংসার ছেলেদের পড়াইতে কষ্ট হয়। মেয়েদের কিভাবে পড়াব। তাছাড়া মেয়েদের বিয়ে শাদী হয়ে গেলে অন্যের সংসারে চলে যাবে। তাই কোনো রকমে লিখতে পারলে আর নামাজ পড়তে পারলেই চলবে।
গ্রামাঞ্চলে নারী শিক্ষার জন্য ধর্মীয় গোঁড়ামী বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু আসলে ইসলামে নারী শিক্ষা কি এ প্রসঙ্গে একজন আলেম বলেন, ইসলাম কোনো গোঁড়ামীর ধর্ম নয়। ইসলাম উদারতার ধর্ম। উদারতার সুযোগ নিয়ে নৈরাজ্য সৃস্টি ইসলাম কখনই সমর্থন করে না। শিক্ষা অন্বেষণের জন্য নারীকে ইসলাম সমর্থন করে। গঙ্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জোবেদা কামরুন নাহার বলেন, জাতীয় শক্তি বৃদ্ধিতে শিক্ষা অবশ্যই দরকার। তবে নারী শিক্ষার অগ্রগতি ছাড়া এ শক্তি যোগাড় অসম্ভব। দেশের সার্বিক উন্নয়নে মেয়েদের শিক্ষাকে আরো উৎসাহ যোগানোর দরকার বলে তিনি মনে করেন।
নারীদের পড়ালেখা না করানোর পেছনে অভিভাবকদের অসচেতনতাই মূল কারণ বলে মনে করেন পূর্ব নূরপুরের আনোয়ারা বেগম খুশী। তিনি আরো বলেন, অনেক অভিভাবকদের নিজের কর্মক্ষেত্রে সহকারী কিংবা সাহায্যকারী হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে তাদের মেয়ে সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণ হয় না।

কেস স্টাডি :শিশু শ্রমের কারণে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যকর হচ্ছে না
গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্যের কথা বিবেচনায় রেখে সরকার শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করলেও তা আশানুরূপ ফল দেয়নি। গ্রামাঞ্চলের অনেক শিশুই শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। সোন্দালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বলেন, দারিদ্র্য শিশু শ্রমের মুল কারণ। সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে হবে।
প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র পদুয়া শাখার শিক্ষিকা বলেন, অভিভাবকদের উদাসীনতা এবং শিশু শ্রমের প্রতি প্রণোদনার ফলে শিশুরা ধীরে ধীরে এক সময় স্কুল বিমুখ হয়ে পড়ে এবং সার্বক্ষণিক শ্রমে নিয়োজিত হয়।
সরেজমিন দেখা যায় অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের কাজ করার মত বয়স হওয়া পর্যন্ত স্কুলে কিংবা উপানুষ্ঠানিক কেন্দ্রগুলোতে পাঠায়। শ্রম দেওয়ার মত একটু শারীরিক সামর্থ হলেই অভিভাবকরা তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে শ্রমে নিযুক্ত করে।
নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষা গ্রহণের অনুকুল সুযোগ সুবিধা থাকা স্বত্ত্বেও অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠান না। চর লামছির আকাব্বর মিয়া বলেন, আমাদের সারাজীবন কাজ করে। খেটে খেতে হয়। লেখাপড়া শিখে কি লাভ? আমরা যেভাবে আছি সারাজীবন সেভাবেই থাকতে হবে। তাই ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা কাজ শিখে নিলে শক্ত হতে পারবে। তবে নলুয়া চরের আবদুস সেলাম মেম্বার এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার মতে মানুষ সর্বদা অনুকরণশীল। শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করা চরের মানুষের অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। তাই চরাঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের বিদ্যালয় কিংবা শিক্ষার সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও অভিভাবক তাদের ছেয়েমেয়েকে শ্রমে নিয়োগ দিয়ে থাকে। এটাকে তিনি সামাজিক পারিপাশ্বিকতার ফল বলে উল্লেখ করেন।
বানদত্ত জামে মসজিদের পাশে ইট ভাঙছে ১১ বছরের সুমন মিয়া। সুমন মিয়ার একান্ত ইচ্ছে লেখাপড়া করা। কিন্তু তার বাবা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ালেখার খরচ চালাতে পারবে না তাই তাকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর তাকে আর হাই স্কুলে ভর্তি করায়নি। সুমন মিয়া দরিদ্রতার কারণে পড়াশোনা বন্ধ করে এখন তার বাবার সাথে ইট ভাঙে।
অশ্বদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য মফিজ উল্যাহ বলেন, এ দেশে শুধু আইন করে শিশু শ্রম বন্ধ করা যাবে না এবং তা সম্ভব নয়। সত্যিকার শিশুশ্রম বন্ধের জন্য অভিভাবক সচেতনতার পাশাপাশি মালিক পক্ষকে সৎ হতে হবে।

সুপারিশ
সরেজমিন আলাপকালে গ্রামীণ জনগণ গ্রামীণ শিক্ষার সমস্যা নিয়ে যেমন কথা বলেন, তেমনি সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন মতামত দেন। নিুে তা সুপারিশ আকারে পেশ করা হল
- শিক্ষা কর্মসূচিতে আরো স্বচ্ছতা আনা
- শিক্ষকদের দায়িত্ব বহির্ভূত কাজ কমিয়ে আনা
- বিদ্যালয়সমূহে যাবতীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা
- প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহে ৪০:১ হারে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া
- প্রত্যেক গ্রামে মাসিক অভিভাবক সমাবেশ করা
- শিক্ষা গ্রহণে সরকারি প্রচার প্রচারণা বাড়ানো
- ম্যানেজিং কমিটিতে শিক্ষিত সদস্যের হার বৃদ্ধি করা
- প্রত্যেক শ্রেণীতে বাধ্যতামূলক কৃতকার্যতা বন্ধ করা (শিবিখার ক্ষেত্রে)
- মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে তুলা
- গম কিংবা বৃত্তি নয়, ছাত্রছাত্রীর মাঝে শিক্ষা উপকরণ দেওয়া
- গণশিক্ষাকে আরো ব্যাপকভাবে স¤প্রসারণ করা
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে গণশিক্ষা কেন্দ্রস্থাপন করা
- ইউনিয়ন পরিষদকে প্রাথমিক শিক্ষা স¤প্রসারণে আরো সক্রিয় হতে হবে।
- শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম বন্ধ করতে হবে।

Sunday, July 15, 2007

জলের যন্ত্রনা থেকে ৪০ বছরেও মুক্তি পায়নি নোয়াখালীবাসী

দীর্ঘ ৪০ বছরেও জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি নোয়াখালীবাসী । খাল দখল, খাল ভরাট, মাছ চাষের জন্য খালে বাঁধ তৈরি, খাল পরিষ্কার না করা, যত্রতত্র বেয়াল জাল পাতা, সরকারি সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, যথেচ্ছভাবে স্লুইস গেট নিয়ন্ত্রণ করাসহ প্রভৃতি কারণে নোয়াখালীর দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলাবদ্ধতার কারণে জেলার প্রায় ৮৬ হাজার ৪৮৫ একর জমি বছরের নয় মাস জলমগ্ন থাকে। তাছাড়া এ সময় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়। অনেকে জলাবদ্বতার কারণে সে সময় বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে। সেই সাথে পরিবেশ- প্রতিবেশেও মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেয়। পশুসম্পদ, মৎস্যসম্পদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
নোয়াখালী জেলার অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। কিন্তু জলাবদ্ধতা ও শুকনো মৌসুমে সেচের অভাবে বর্তমানে ফসল উৎপাদনে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ জেলায় মোট আবাদযোগ্য দুই লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমির ৮১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিই এক ফসলি। অন্যদিকে তিন ফসলি জমির পরিমাণ মাত্র ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও রবি মৌসুমে এ অঞ্চলে ৬৫ শতাংশ জমিতে পানি জমে থাকে।
সোন্দলপুরের মাঈন উদ্দিন বলেন, আগে আমরা জমি থেকে তিনটি ফসল পেতাম- আউশ ও রবি শস্য। কিন্তু এখন শুধু আমাদের ইরির চাষ করতে হয়। আউশ রোপণের সময় পানির দরকার নেই। অথচ সে সময়ও জমিতে পানি থাকে। আবার আমন চাষে জমিতে পানি লাগে কম। কিন্তু সে সময়ও জমিতে পানি থৈ থৈ করে। রবি মৌসুমেও জমি থেকে পানি শুকায় না। ফলে সে সময় রবিশস্য চাষ করা যায় না।
বড়রামদেবপুরের জাহাঙ্গীর বলেন, জমিতে হানি আটকি থাইকলে দান জন্ডিসের মতন অই যায়, দান ত অয়ই না - এ ধানের খের গরুরে দিলে গরুয়েও খায় না।
তিনি আরো জানান, কোনো কৃষক এ সময় ধান চাষ করলেও জমিতে ধান হয় না। জলাবদ্ধতার কারণে ধান ‘উরবা’ যায়। কোনো কোনো জমির ধান মরে যায়। আবার অনেক সময় ধানের গোড়া নরম হয়ে পচে যায়। এ সময় ধান গাছে গোছা আসে না বলে তিনি জানান।
নরোত্তমপুরের আবদুর রব বলেন, আগে জমির ধানে বছর যেত। এখন আর বছর যায় না। আগে যেখানে ধান পেতাম বছরে ৪০ মণ এখন সেখানে ধান আসে ১৮/২০ মণ। ফলে দেনা করে সংসার চালাচ্ছি। দেনার টাকা শোধ করতে কয়েক বছর আগে একবার জমি বেচেছি। এভাবে অনেকের জমিজমাও কমে আসছে। এলাকার মানুষ কৃষির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। মাঈন উদ্দিন বলেন, চাষাবাদ করব লাভের জন্য কিন্তু এখন চাষাবাদ করে প্রতি বছর লোকসান দিতে হয়। তিনি জানান, গত বছর তিনি ঋণ নিয়ে দুই একর জমি চাষ করে মাত্র ১৫ মণ ধান পেয়েছেন। এ জন্য এ বছর তিনি নিজে চাষ না করে জমি বর্গা দেবার কথা চিন্তা করছেন।
নোয়াখালী জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, যদি নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা নিরসন করা যায় তাহলে বছরে অন্তত দুই লাখ ১৬ হাজার ২১২ টন বেশি ধান উৎপাদন করা যেত।
অশ্বদিয়ার মফিজ মিয়া বলেন, এক সময় এ অঞ্চলে ডাল, সরিষা, মরিচ ও আলু চাষাবাদ হতো। কিন্তু এখন করা যায় না। কারণ যে সময়ে জমিতে এগুলো চাষাবাদ করা হয় সে সময়ও আমাদের এখানে জমি থেকে পানি শুকায় না।
বর্ষা মৌসুমে নোয়াখালী শহরের মানুষ কার্যত পানিবন্দি হয়ে পড়ে। আবদুর রহিম নামের একজন রিকশাচালক বলেন, হোরসবার চেয়ারম্যান কোনো এইকগা ডেইন করে না। রাস্তার লগের ডেইন হগল সাপ করে না। হিল্লায় হানি জমে। হানি জমি এইকগা রাস্তা বালা নাই। কনো রাস্তা দি রিকশা চালাইতাম হারি না। বেক বাঙা। জানা যায়, এক সময় মাইজদী শহর থেকে পানি গিয়ে পূর্বে নোয়াখালী খালে পড়তো। তাছাড়াও বক্সিমিজি পোলের কাছ থেকে ইসলামগঞ্জ হয়ে পশ্চিম ছত্তরের খাল ও মালেক খালে পানি পড়তো। কিন্তু বর্তমানে এসব খালের অনেক জায়গায় বন্ধও ছোট হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

কৃষি অধিদপ্তরের কথা
জেলা কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা বলেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ও ভূমি গঠনের ক্ষেত্রে জেলার দক্ষিণাংশের জমিগুলো উচুঁ হওয়ায় নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তিনি জানান, নোয়াখালীতে মোট ৩৫ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত। অথচ এসব জমিতেও আমন করা যেত। নোয়াখালীতে ২০০০-২০০১ সালে চার লাখ ৫৬ হাজার ৮৪৬ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন হয়েছে। জেলায় খাদ্যের চাহিদা ছিল চার লাখ পাঁচ হাজার ৯৯৬ মেট্রিক টন। খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিলো ৫০ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন।
তিনি আরো জানান, যে পরিমাণ জমি জলাবদ্ধ যদি সে জমিতে বছরে আড়াই টন করেও খাদ্য উৎপাদন হতো হবে বছরে আরো প্রায় সোয়া দুই লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্য উৎপাদন করা যেত। জলাবদ্ধতা এ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য একটি বড় অভিশাপ। জলাবদ্ধতা বিষয়ে কৃষি বিভাগের কোনো পরিকল্পনা আছে কীনা এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আমাদের কোনো কিছুই করার নেই। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড -কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরের মাঝ দিয়ে খাল করার পরিকল্পনা করেছে।

নোয়াখালী খাল জলাবদ্ধতার আসল কারণ
মেঘনার যে শাখাটি পশ্চিমের শাহবাজপুর নদী থেকে বেরিয়ে লক্ষীপুরের ভবানীগঞ্জের প্রান্তরেখা ছুঁয়ে সুধারামের দক্ষিণে ফেনী নদীর মোহনায় পড়েছে সেটি নোয়াখালী খাল। লক্ষ্মীপুরের বইবালা পয়েন্টে মেঘনার এই শাখাটির ওপরে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয় তাতে রামগতি ও সুধারামের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় চর পড়ে।
এ সময়ই ভুলুয়া নদী কার্যত ভরাট হতে থাকে এবং বর্তমানে বয়ার চরের দক্ষিণ মাথায় খালটি এসে ভরাট হয়ে যায়। ফলে পানি নামার পথও রোধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সাগর যত দক্ষিণে সরে গেছে এ খালের তলদেশে বালি জমে জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে খাল ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। আবার খালে স্রোত না থাকায় সংযোগকারী খালগুলোও ভরাট হয়ে যায়। এতে করে নোয়াখালী খাল এখন নোয়াখালীর মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জলাবদ্ধতায় দুষিত পরিবেশ
নরোত্তমপুরের আবদুর রব বলেন, জমিতে যে ফলন হয় তাতে মানুষের সংসার চলে না। এখন অনেকে বাপ-দাদার পুরোনো পেশা থেকে ছিটকে পড়ছে। জমি এক ফসলি হয়ে যাবার কারণে কাজ কমে যাচ্ছে। বড়রামদেবপুরের আবুল মিয়া আগে বর্গা জমি চাষ করতো। তিনি জানান, আগে যা চাষ করতাম তাতে সংসার চলত। চাষের মৌসুম ছাড়া অন্য সময় বাইরে মজুরি দিতাম। কিন্তু এখন আর সে লাভ নেই। তাই জমি চাষ বাদ দিয়ে রিকশা চালাই। এ রকম অবস্থা অশ্বদিয়ার মোরশেদ মিয়া, বড়রামদেবপুরের হোসেন, পরশুরামের কেতু মিয়া। তারা এখন কেউ সাইকেল গ্যারেজের মালিক, কেউ স্কুলের পিয়ন, কেউ দিনমজুর হয়েছেন। ছিঁটকে পড়েছেন পূর্ব পেশা থেকে।
সদর উপজেলার খোদেদাদপুরের মফিজ মিয়া জানান, জলাবদ্ধতা শুধু ধানের ক্ষতি করে না, প্রতিবছর জলাবদ্ধতা কারণে তার চার/পাঁচটি করে সুপারি গাছ মারা যায়। আলাপকালে অনেকে বলেন, প্রতি বছর জলাবদ্ধতায় জেলার প্রায় দু হাজার নারিকেল, সুপারি ও কাঁঠাল গাছ মারা যায়।
বড়রামদেপুরের মেম্বার আহম্মদ উল্যাহ জানান, প্রতি বছর বর্ষাতে প্রতিটি মাটির রাস্তাই পানিতে ডুবে যায়। এতে করে বর্ষার শেষে আর সে সব রাস্তা ব্যবহার করা যায় না। এজন্য প্রতি বছর রাস্তাগুলো সংস্কার করতে হয়।
বড়রামদেবপুরের আবুল মিয়া বলেন, জলাবদ্ধতায় গবাদি পশু পালনেও মারাত্মক সমস্যা গো-খাদ্য পাওয়া যায় না। শুকনো খড় এখন বাজারে বেচাকেনা হলেও তা কেনার সাধ্য থাকে না। এ সময় গরু-ছাগল শুকিয়ে হাড় জিরজিরে হয়ে যায়। আবার অনেক পশু রোগাক্রান্তও হয়ে পড়ে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড
নোয়াখালীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম নাজমুল হক বলেন, জলাবদ্ধতা নোয়াখালীর অন্যতম সমস্যা। জমি ব্যবস্থা, খালে পানি না যাওয়া, প্রাকৃতিকভাবে খাল বন্ধ হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা নির্মাণের কারণেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থার আওতায় সিডিএসপি-২ বৃহত্তর নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লাকে নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। পানি নির্বাহী প্রকৌশলী আরো জানান, উক্ত সমীক্ষায় সাউথ কুমিল্লা, নর্থ নোয়াখালী সেচ প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। যেহেতু এটি একটি বড় প্রকল্প তাই ভেঙে ভেঙে কাজ করতে হবে। বর্তমানে প্রকল্পে দু একটি অংশের কাজ চলছে। যদি দাতারা টাকা দেয় তাহলে কাজ করা যাবে। নইলে আবার কাজ থমকে যাবে।
জলাবদ্ধতা নিরাসনে যে সব পরিকল্পনা পানি উন্নয়ন বোর্ড গ্রহণ করেছে সেগুলো হলো:
১। বামনীতে ১৪ পোন্ডারের যে স্লুইস আছে সেটিকে ২৮ পোল্ডারে উন্নীত করে কালামুন্সি খালের পানি বামনী স্লুইস গেট দিয়ে সন্দ্বীপ চ্যানেলে ফেলা।
২। ছোট ফেনী নদী বন্ধ করে দিয়ে ছোট ফেনী নদীর পানি ও নতুন ডাকাতিয়ার পানি মুছাপুরের রেগুলেটর দিয়ে সন্দ্বীপ চ্যানেলে নির্গমণ করানো।
৩। নোয়াখালী খালের মুখের অংশ যেহেতু উঁচু হয়ে গেছে সেহেতু নোয়াখালী খালে রেগুলেটর স্থাপন করলেও কাজ করবে না। তাই নোয়াখালী খালের পানি নবগ্রামে স্লুইস নির্মাণ করে নদীতে ফেলা।
৪। এ অঞ্চলের সাথে বামনী খালের যেহেতু কোনো সংযোগ নেই তাই এ এলাকার পানি আলগি খালে ফেলে তা বামনী স্লুইস দিয়ে সন্দ্বীপ চ্যানেলে ফেলা।
৫। নতুন ডাকাতিয়ার পানি ওয়াপদা খাল দিয়ে রহমতখালীর মাধ্যমে মেঘনায় ফেলা।
বর্তমানে রহমতখালীতে স্লুইস স্থাপন, নোয়াখালী খালের নবগ্রামে স্লুইস স্থাপনও বামনীতে স্লুইস নির্মাণের কাজ চলছে বলে নির্বাহী প্রকৌশলী জানান। আগামী বছর মুছাপুর স্লুইসের কাজ হবে বলে জানান। এছাড়া যেসব কাজ রয়েছে সেগুলো অর্থের অভাবে করা যাচ্ছে না। টাকা পাওয়া গেলে সেগুলো করা হবে বলেও তিনি জানান।

জলাবদ্ধতার কারণ
খাল দখল, খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ,খাল ভরাট, খালের যত্রতত্র বেয়াল জাল ফেলার কারণেই মুলত জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সোন্দলপুরের অনেক খাল জমির মালিকরা খালের পাশে যার জমি সে খালের কিছু অংশ ভরাট করে জমি বাড়িয়েছেন। ফলে খালের প্রশস্ততা কমে গেছে।
এছাড়াও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা। এ প্রসঙ্গে বড়রামদেবপুরের মোস্তফা মিয়া বলেন, অনেকে মাছ চাষের জন্য যত্রতত্র বাঁধ দেয়। এতে করেও পানি জমে থাকে। আবার অনেকে খাল সেচে মাছ ধরার জন্যও খালে দিয়ে পানি নামতে পারে না।
আবার অনেক খালে বেয়াল জাল পেতে রাখে। ফলে খাল দিয়ে পানি চলাচল বাধা পায়। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, প্রত্যেকে এলাকায় আমাদের ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট কমিটি রয়েছে। এগুলো তারা দেখাশুনা করেন। আমরা তো আর খাল পাহারায় লোক লাগাতে পারি না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরো বলেন, আমাদের একটি বিভাগের সাথে আরেকটি বিভাগে সমন্বয় নেই এজন্যও জলাবদ্ধাতার সৃষ্টি হয়। দেখা যায় আমরা কোথাও জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছি অন্যদিকে এলজিইডি সেখানে রাস্তা বানাচ্ছে। ফলে আবার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
সদর পূর্বাঞ্চলের অনেক খালেই দীর্ঘদিন কোনো কাজ হয়নি। সোন্দলপুরের মোস্তফা বলেন, গত বছর কালামুন্সি খালের খনন কাজ হয়েছে। কিন্তু এটা কোনো কাজ নয়।
যে মেম্বার কাজ করিয়েছে তিনি সব টাকা খেয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। খাল থেকে মাটি তোলার জন্য যে পরিমাণ গম বরাদ্দ ছিল সে পরিমাণ ওজনের মাটি কাটা হয়নি। তিনি বলেন, খাল কাডে ন, খালেরে সেব করাইছে।

স্যানিটেশন
জলাবদ্ধতার কারণে রোগ-বালাই হয়ে দাঁড়িয়েছে পূর্বাঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনের সঙ্গী। কান্দিরপাড়ের আবুল বলেন, পানি আটকা পড়লে পুকুরের পানি বিলের পানি, পায়খানার পানি সব এক হয়ে যায়। তখন সে পানি গোসলে, রান্না করতে, খাবারে সব কাজে ব্যবহার করতে হয়। ফলে অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তিনি আরো জানান ডায়রিয়ায় প্রতি বছর তার গ্রামে ২/৩টি শিশু মারা যায়। এছাড়া প্রত্যেকেই চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়।

কেস স্টাডি
মোরশেদ মিয়ার বাড়ি অশ্বদিয়ার পূর্ব নূরপুর গ্রামে। অনেক দিন সৌদি আরবে ছিলেন। ৮ ছেলেমেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী মিলে ১০ জনের সংসার। সৌদি আরব থেকে ফিরে শুরু করেন চাষাবাদ। বিদেশ থাকতেই প্রায় ৫ একর জমি কিনেছেন। ভালোই ফলন হচ্ছিল। একদিকে ধান অন্যদিকে আলু, মরিচ এসব চাষ করতেন। বছরে ধান আসতো ১৩০ থেকে ১৫০ মন। গোলা ভরে যেতো ধানে। সংসারের জন্য যা দরকার তা রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিতেন। ধান বিক্রির টাকা জমিয়ে বড় মেয়ের বিয়ে দেন। হঠাৎ করে যেন আল্লাহ বিরাগ হয়ে পড়ে। তিন ফসলি জমি সব এক ফসলি হয়ে যায়। বছরের বেশি সময়ই জমিগুলো থাকে পানির নিচে। তবু চাষ করে। কিন্তু যে টাকা খরচ করে চাষ করে ফলন উঠলে সে টাকাও ওঠে আসে না। এভাবে মোরশেদ মিয়ার দিন দিন দেনা হতে থাকে। এক সময় দেনা হয়ে যায় গলা পরিমাণ। পরে দেনা শোধ করতে অনেক জমিই বেচতে হয়।
শেষে বুড়ো বয়সে এসে মোরশেদ মিয়া যেটুকু জমি আছে সেটুকুও বিক্রি করে সাইকেল গ্যারেজ দিয়েছেন। মোরশেদ মিয়া বলেন, এখন কোনো দিন ১০০ টাকা কোনোদিন আরো বেশি আয় হয়। তাতে ভালোই চলে। কিন্তু জমি চাষের টারি আর কপালে সয় না।

Friday, July 13, 2007

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ //চাই বহুরৈখিক উদ্যোগ, দরকার সহভাগীতা

এখন নাগাদ মানুষের ইতিহাস বিভাজিত। বিভাজনের মধ্যে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, সম্পদ এবং শ্রম। মানব প্রজাতির মধ্যেও এই বিভাজন লিঙ্গভেদে ক্রিয়াশীল। এই প্রজাতির পুরো অর্ধেকটাই ইতিহাস থেকে অদৃশ্য। তাকে তুলে আনা হয়েছে আধিপত্যশীল লিঙ্গের প্রয়োজন মত, তাদের ইচ্ছা ও আবেগ অনুযায়ী। সর্বদাই উপস্থিত কিন্তু সর্বদাই আত্মপরিচয়হীন এই প্রজাতিই হচ্ছে নারী।
বাংলাদেশের নারী সমাজ অবহেলিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। নানামাত্রিক সহিংসতার শিকার। এইসব অবস্থান তার অসহায়ত্ব ও অধঃস্তনতাকে প্রকাশ করে। নারীর এই সরলরৈখিক অবস্থান দরিদ্র বা নিন্মবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শহর বা গ্রাম সকল ক্ষেত্রেই উপস্থিত। এর ধরণ কেবল মাত্র ক্ষেত্র বিশেষে তার চরিত্রকে বদল করে নেয়। কিন্তু আমাদের গ্রামীন জীবনে নারী নির্যাতনের সহিংসতার রয়েছে নানামাত্রিকতা ও ভিন্নতা।
সুবিধার জন্য আমরা আগে সহিংসতা বলতে কী বুঝি তা আলোচনা করে নিতে পারি। যে তৎপরতা নারীর শরীর, মন বা যৌনতার ক্ষতি হয় বা হতে পারে, যা স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, তাই নারীর জন্য সহিংসতা। পুরুষপালিত সমাজ ব্যবস্থার কারণে একটি পরিবারে নানা কারণে নারী নির্যাতন সংঘটিত হয়। নারী নির্যাতন শুরু হয় একজন নারী জন্ম নেবার আগ থেকে মৃত্যূ নাগাদ। নারী-পুরুষের মধ্যকার অসম ক্ষমতা সম্পর্কই হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারী নির্যাতনের কারণ ও পরিণাম দুই-ই। নারী নির্যাতন আসলে নারীর অধঃস্তনতার আরেকটি রূপমাত্র। নারীর প্রতি এ সহিংসতা হচ্ছে সমতা ও উন্নয়ন, শান্তির লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম প্রধান বাধাঁ। একই সাথে নারী নির্যাতন দারিদ্র্য হ্রাসকরণের পথে একটি অন্যতম বড় বাধাঁ। বিশ্বব্যাংক সমীক্ষা মতে, বিশ্ব জুড়ে ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতনের ফলে ১৫-৪৪ বছর বয়সী নারীরা যক্ষা, গর্ভকালীন সংক্রামক, ক্যান্সার বা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া ও তাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। নারী নির্যাতন নারী ক্ষমতায়নকে সংকুচিত করে। সেই সাথে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বড় রকমের বাধাঁ তৈরি করে। আমাদের প্রতিদিনের চলার পথে আমরা যে সব নারী নির্যাতনের ধরন ধারণ দেখতে পাই-ক্স প্রত্যক্ষ বা প্রকাশ্যে দৈহিক নির্যাতনক্স মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতনক্স যৌন নির্যাতনক্স প্রজনন অধিকার হরণসংক্রান্ত নির্যাতনক্স প্রচলিত রীতি-নীতি বা কুপ্রথাভিত্তিক নির্যাতনক্স নারীকে পণ্যে পরিণত করাক্স সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নিপীড়ন
গত জুলাই ২০০৫ মাসে নোয়াখালীতে মোট ০৬ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ০৬টি-ই সংঘটিত হয় নারীর বিরুদ্ধে। ১৬ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয় ‘সেনবাগে ধর্ষণের অভিযোগে একজনকে গণপিটুনি’, একই দিন দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয় ‘বেগমগঞ্জে স্বামী-ননদের হাতে গৃহবধু খুন’, ১৭ জুলাই তারিখে দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয় ‘ ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে নোয়াখালীতে গৃহবধুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা, ধর্ষককে পুলিশে সোপার্দ’, বাড়িঘর ও জমিজমা দখলে প্রভাবশালীদের ষড়যন্ত্র, নোয়াখালীর অসহায় নারী সেলিনা বিচার ও নিরাপত্তা চান’-এ সংবাদটি ২৩ জুলাই তারিখে দৈনিক ভোরের কাগজে ও ২৫ জুলাই তারিখে সাপ্তাহিক নয়া সংবাদে প্রকাশিত হয়, ২৬ জুলাই তারিখে দৈনিক ভোরের কাগজে ‘চাটখিলে স্কুলছাত্রী ধর্ষিতা, ধর্কষকে থানায় সোপার্দ’, এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়, ‘বেগমগঞ্জে খোকা মেম্বার বাহিনীর হামলা, গৃহবধূর শ্লীনতাহানী, আহত ৩, এ সংবাদটি ২৫ জুলাই তারিখে সাপ্তাহিক নয়া সংবাদে প্রকাশিত হয়। এ তথ্যগুলো চারটি দৈনিক (প্রথম আলো, ভোরের কাগজ, সমকাল, আমাদের সময়) ও নোয়াখালী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়। আমরা জানি আমাদের চারপাশে প্রতিদিন এ চেয়ে অনেক বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে ওঠে আসে খুবই কম। কিন্তু আমাদের গ্রামগুলোতে যে সব উন্নয়নকর্মীরা কাজ করছেন তারা প্রতিদিন গ্রাম থেকে ফিরে এসে অনেক কষ্ট ও নারীর বিরুদ্ধে পরিচালিত নানা সহিংসতার কথা বর্ণনা করেন। গণমাধ্যম ও যোগাযোগ কর্মীরা যে সব ঘটনার কথা তুলেআনেন তা মূলত যেসব ঘটনা দৃশ্যত: হয় তা বলতে পারেন। কিন্তু নারীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় এ চেয়ে অনেক বেশি সহিংসতা। ‘গৃহ নির্যাতন’ অদৃশ্য নির্যাতনের সবচেয়ে বড় অধ্যায়। আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় নারী নির্যাতনের নানা ধরণ থাকলেও ‘গৃহ নির্যাতন’ আমাদের জীবনের প্রতিটি শ্রেনীতে বিদ্যমান। তসলিমা নাসরিনের এক চিঠি তিনি তার বোনকে লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর সব স্বামী বিয়ের পর স্ত্রীর ওপর তাদের যে অধিকার আছে সে অধিকার ফলাতে চেষ্টা করে। কেউ কেউ স্থুল ভাবে, কেউ কেউ সুক্ষভাবে করে। যেমন ধর, হঠাৎ বললো এই এক গ্লাস পানি দাও তো। অথচ হাতের কাছেই পানির গ্লাস।’ এ ধরনের আচরণ বা পুরুষভাবাপন্নতা দিয়ে হয় নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা। বেশির ভাগ সময়ই নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরু হয় পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময়। অবন্তি হারুন ও আইনুন নাহার গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়নের মিথ প্রবন্ধে বলেছিলেন, গ্রামীন বাংরাদেশে যে ধরণের পারিবারিক প্রথা চালু রয়েছে তাতে গৃহস্থালীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোষত্রে দ্ধন্ধ ও আপেষের যে সমবেত প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল, তা শুধুমাত্র নিজ নিজ আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রন দ্ধারা বোঝা সম্ভব নয়। আমরা এ কথা দিয়ে আজকের সময়ে নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হলেও পারিবারিক প্রতিদিনের জীবন চক্রে নারীরা একনো আদিম সময় ও প্রথা দ্বারা বেষ্টিত। ফারহাত জাহান, আরশাদ সিদ্দীকি ও জাভেদ হোসাইন নোয়াতালীর চরাঞ্চলে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা শিরোনামে একটি গবেষণা পরিচালানা করে। গবেষণায় দেখা যায় সোখানকার নারীরা ‘ভাত রান্না হতে দেরী হওয়া, সময় মতো গামছা লুঙ্গি হাতের কাছের না পাওয়া-এ সবের কারণে স্বামীর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা, দু’চারটি চড়-থাপ্পড় দিয়ে দেয়াকে তারা দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ বলে মনে করেন। স্বামী কতৃক মার খাওয়ার মধ্যদিয়ে নাক দিয়ে রক্ত পড়া, দাঁত পড়ে যাওয়া, হাত-পা মচকে বা ভেঙ্গে যাওয়া, চুলের মুঠি ধরে লাথি, লাঠি বা ঝাড়– দিয়ে বদম প্রহারকে মারধোর এর অন্তর্ভূক্ত করেন তারা।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও পিআরএসপি‘ ইতোমধ্যে সরকার দারিদ্র্য হ্রাসকরণ কৌশলপত্র তৈরি করেছে। আগামিতে এ কৌশলপত্রের আলোকে দেশ পরিচালিত হবে। পিআরএসপিতে উন্নয়ন ও সুশাসনের সাধে নারীদের কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ঘটনা ২০০৭ সালের মধ্যে ১০০ ভাগ রিপোটিং করা হবে ; রিপোর্টেড ঘটনার ৫০ ভাগ হ্রাস করা হবে। এরজন্য এ সময়ের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের হেফাজতে নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা ; চিকিৎসা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা ; নারীর অধিকারকে আক্রান্ত করেছে এমন মামলাগুলো বিচারে সিডিও বিধিমারা প্রয়োগ করার জন্য বিচার ব্যবস্থাকে সংবেদনী করার কথা বলেছে। একই সাথে এ দলিলে আগামিতে আক্রান্তদের মানসিক সহায়তা প্রদান ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন প্রয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতি১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে একটি নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত হয়। বেইজিং সম্মেলনের পর এ নীতিমালা প্রণযন করা হয়। বাংলাদেশ এ নীতিমালার জন্য বিভিন্ন সময় প্রশংসিত হয়েছে। কিন্ত ইতোমধ্যে এ নীতিমালা নিয়ে একটি হাস্যকর অবস্থা তৈরি করেছে। কে বা কারা নীতিমালার বিশেষ বিশেষ অংশ পরিবর্তন করে ফেলেছে। বিশেষত: যে সব জায়গায় নারীদের সম্মান ও মর্যাদার কথা লেখা ছিলো সেসব জায়গা বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দারুন লজ্জার একটি বিষয়। এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল মধ্যেও এক ধরণের হাস্যকর জবাবদিহিতা তৈরি হয়েছে। মন্ত্রী, সচিব, সহকারী সচিব কেউ-ই জানেন না কে আইনের এ পরিবর্তন এনেছে। আমরা যে যে অবস্থানে তেকে কাজ করি না কেন আমাদের এ ইস্যুতে দারুন প্রতিবাদ ও ঘৃণা জ্ঞাপন করা উচ্তি। এটি নারী নীতিমালার প্রতি রাষ্ট্রীয় সহিংসতার নামান্তর।
জাতিসংঘ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন১৯৯৫ সালের ৪-১৫ সেপ্টেম্বর চীনের বেইজিং এ জাতিসংঘ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। সম্মেলনে জাতিসংঘের ১৯০টি সদস্য দেশের সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক এই সম্মেলনে সকলে একমত হয়ে ‘বেইজিং ঘোষণা’ ও ‘কর্মপরিকল্পনা’ গ্রহণ করেন। ৩৮ ধারা বেইজিং ঘোষণা মূলত সরকার সমূহের অঙ্গিকারনামা। পৃথিবী জুড়ে নারী সমাজের বৈষম্যপূর্ণ অসম অবস্থা ও অবস্থানের বিষয়ে একমত হয়ে সরকারসমূহ নারীর পূর্ণ সমতা, উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্যে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। বেইজিং ঘোষণায় নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধ ও বিলোপে সমন্বিত পদক্ষেপের কাথা বলা হয়েছে। ঘোষণায় সরকার, স্থানীয় সরকার, বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও ব্যক্তিখাত, বিশেষভাবে গণমাধ্যম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের করণীয় তে বলা হয়েছে, ক্স সহিংসতার শিকার নারীদের ত্রাণ, চিকিৎসা ও জীবিকার সুবিধা দিতে হবে। জনসাধারণকে যুক্ত করার জন্য সহিংসতাবিরোধী ঐতিহ্যগত সূত্র বের করতে হবে। ক্স বাড়াতে হবে সচেতনতা। ক্স উন্নত করতে হবে তথ্য ও শিক্ষার সকল রকম ব্যবস্থা করতে হবে। ক্স সহিংসতার বিরুদ্ধে সবাইকে সহমর্মী করে তোলার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। ক্স নারী পুরুষের পারষ্পরিক মর্যাদা উপলব্ধির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে।
বেইজিং ঘোষণায় সকল সরকার, মালিক পক্ষ, ট্রেড ইউনিয়ন, স¤প্রদায়গত ও যুব সংগঠন এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর করণীয় নির্ধারণ করা হয়ক্স শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র ও অন্যান্য জায়গায় সহিংসতা বিরোপের কর্মসূচি গ্রহণ ও বিকশিত করতে হবে।ক্স কিশোরী বা তরুণী বিপদে পড়তে পারে এমন জায়গায় চিকিৎসাসহ সহায়ক সুবিধা থাকতে হবে।ক্স সকল সামাজিক কুপ্রথা বিলোপ করতে হবে, যা বৈষম্য তৈরি করে।
তবে এ কথা সত্য যে, নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা দ্রুত বৃদ্ধির পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতাও ক্রমাগত বাড়ছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রচারণা জোরদার করা, নির্যাতিত নারীদের সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে এনজিও, নারী সংগঠন তথা সুশীল সমাজ আজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তবু আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় আমরা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হ্রাস করতে আমরা কিছু সাধারণ নির্দেশনা তৈরি করতে চাই।
আইন সংশোধন ও সংস্কার১. নারী নির্যাতনের বিচার পাবার ক্ষেত্রে আগে আইন ব্যবস্থায় বিদ্যমান এ সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতাগুলি চিহিৃত করতে হবে এবং তা সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।২. নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি ভিত্তি স্বরূপ নারীর উত্তারধিকার ও সম্পত্তি অধিকারকে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
আইনের প্রয়োগ১. বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।২. ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের বিচারের ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করতে হবে।
পুলিশ প্রশাসন১. নারী নির্যাতন সংক্রান্ত এফআইআর রেজিস্টিশনের পথে সকল বাধাঁ দূর করতে হবে, এখানে এসে নারীরা পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়।২. পুলিশকে নির্যাতন তদন্তকালে তাদের সক্রিয়তা বা নিস্ক্রিয়তার জন্য জবাবদিহি ও দায়বদ্ধ থাকতে হবে।৩. সকল পুলিশ স্টেশনে ‘নারী সেল’ গঠন করতে হবে এবং নারী নির্যাতন সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ পুরোপুরি তদন্ত করার মত পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা তাদের প্রদান করতে হবে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা১. নারী নির্যাতনের বিচারের ক্ষেত্রে আইনী ব্যবস্থার সফল উদাহরণগুলি গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে এ দ্বারা মানুষ সচেতন ও সংবেদনশীল হবে।২. নারী নির্যাতন সংক্রান্ত প্রতিবেদন ররগেভাবে উপস্থাপন করা যাবে না।৩. ধর্ষণের শিকার যে তার নাম, ছবি, ঠিকানা সংবাদে ব্যবহার করা যাবে না, বরং ধর্ষকের নাম, ছবি, ঠিকানা প্রকাশ করতে হবে।
আইনজীবীদের দায়১. আইনজীবীদের অবশ্যই বিদ্যমান কোড অব এথিকস্ বা নৈতিক বিধি মেনে চলতে হবে।২. নারী নির্যাতনের বিচার করার জন্য বিচার বিভাগকে সচল রাখতে ব্যক্তি, এনজিও ও অন্যান্য সংগঠনের সাথে আইনজীবীদের আলাপ আলোচনা ও মতবিনিময়ে যেতে হবে।চাপ প্রয়োগকারী দল গঠন১. সহিংসতার গুরুত্বপূর্ণ চলতি ঘটনাগুলি সনাক্তকরণ ও সেগুলির বিচার কার্য তদারকি করা এবং আইনী প্রক্রিয়াকে উৎসাহ দেবার জন্য নাগরিকদের নিয়ে চাপ প্রয়োগকারী দল গঠন করতে হবে।
সহায়ক পরিষেবা প্রদান১. সহিংসতার শিকার এমনতর পরিবারকে নানাবিধ সহায়তা প্রদানের জন্য ফ্যামিলি কাউন্সিলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।২. সহিংসতা পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, এনজিও ও অন্যান্য সংগঠন মিলে একটি জাতীয় কমিটি গড়ে তুলতে হবে।
শেষে করবো গান্ধীজির একটা উক্তি দিয়ে। গান্ধীজি বলেছিলেন ‘সার্বজনিন কাজে নারীর যোগদানই সেই কাজের সাফল্য আনতে পারে। যে সমাজে নারী সম্মানিতা নন সেই সমাজ সভ্য বলে পরিগণিত হতে পারে না।’

কৃষিকেন্দ্রিক শিল্প : আগামি নোয়াখালীর সম্ভবনার সড়ক

বঙ্গোপসাগরের পাড়ে মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত নোয়াখালী জেলা, মেঘনা নদীর ভাঙ্গা-গড়া দ্বারা প্রভাবিত। জেলার অধিকাংশ এলাকা মেঘনা নদীবাহিত পলি দিয়ে গঠিত। ফলে একদিকে যেমন বঙ্গোপসাগরের প্রভাব এ জেলার ওপর রয়েছে তেমনি মেঘনা নদীও এ জেলার প্রকৃতি ও মানুষকে প্রভাবিত করে থাকে। এখানে অন্তহীন সমস্যার মধ্যেও রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এসব সম্ভাবনাকে ঘিরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে আমাদের রয়েছে বহুমাত্রিক ভাবনা। নানান বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা। একদিকে রয়েছে ভুমি ভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা, খাস জমি বন্টন ও শহর উন্নয়নসহ অনেক সমস্যা। অন্যদিকে নতুন জেগে ওঠা চরাঞ্চলে সাধারণ মানুষের জীবিকায়নের জন্য গবাদি পশু ও মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন, বনাঞ্চল ও সবুজ বেষ্টনী, নিঝুম দ্বীপের মতো অভয়ারণ্য সৃষ্টি ও পর্যটন সম্ভাবনাকে ঘিরে ভবিষ্যত কেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা। প্রয়োজন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দূরদৃষ্টি, পরিকল্পনা এবং ঐকমত্য। এসব বিষয়ে হতে পারে আলাপ আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্ক। উদার ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি সবার জন্য বাসযোগ্য সমৃদ্ধ নোয়াখালী গঠনের কাজে।
নোয়াখালী জেলার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। ধারণা করা হয় ১৪০০ থেকে ১০০০ খ্রীস্টপূর্বে প্রথম এ এলাকায় মানব বসতি গড়ে উঠে। প্রাচীনকালে এ এলাকা সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮২২ সালের ২৯শে মার্চ ‘ভুলুয়া’ নামে এ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬৬০ সালের দিকে ত্রিপুরার পাহাড় থেকে বয়ে আসা পানিতে ভুলুয়া জেলার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়। এ দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে এ সময় ডাকাতিয়া নদী থেকে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ি ও চৌমুহনীর ওপর দিয়ে একটি খাল খনন করা হয়, যাকে বলা হয় নোয়া (নতুন) খাল। বলা হয় নোয়াখালী জেলার নামকরণ এ খালের নামানুসারেই হয়েছে। ১৮৬৮ সাল থেকে ভুলুয়া জেলা নোয়াখালী নামে পরিচিত হতে থাকে। জেলার সদর নোয়াখালীর পশ্চিম তীরে সুধারাম নামক স্থানে স্থাপিত হয়। এ জেলার মানুষ ১৮৩০ সালের জিহাদ আন্দোলন এবং ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ১৯৪৬ সালে মহাত্মা গান্ধী এ জেলা ভ্রমণ করেন। এ জেলার মোট আয়তন ৩,৬০১ বর্গ কি. মি., যা সমগ্র বাংলাদেশের আয়তনের ২.৪৪%। জেলার মোট লোক সংখ্যা ২৫.৭১ লাখ। আয়তনের দিক দিয়ে উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে এ জেলার অবস্থান ৫ম এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে ২য়।
ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যেদিয়ে এগিয়ে চলছে নোয়াখালী। এতদিন নাগাদ নদীভাঙ্গা নোয়াখালী বলে কথা চালু ছিল আজকের অবস্থা তার থেকে অনেক ভালোর দিকে। উপকূলীয় মোট ১৯টি জেলার বার্ষিক গড় আয় প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ৫.৪ শতাশ সেখানে নোয়াখালীর আয় প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের মত। সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ। রাজনৈতিকভাবে নোয়াখালী একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হওয়া স্বত্বেও এখানে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা উদাহরণ যোগ্য। উন্নয়ন প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও আপাতঃ বৈপরিত্যের মধ্যেও জেলাবাসীর রয়েছে অনেক মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য। দারিদ্র্যমুক্ত একটি অঞ্চল হিসেবে নোয়াখালী জেলাকে দেখতে চায় সবাই। সবাই চায়, প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার। সমৃদ্ধ শহর। সমৃদ্ধ জেলা।
নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে জেগে ওঠা বিশাল চরাঞ্চল এ জেলার প্রধান শক্তি। ৫-৭ বছর আগে চরাঞ্চল মানে হতাশা, দারিদ্র্য, ফসলহীনতা, অভাব এমন একটি পরিবেশের চিত্র চোখে ভেসে আসত। কিন্তু নোয়াখালীর চরাঞ্চলের আজকের অবস্থা তার ঠিক উল্টো। কৃষি, গবাদিপশু, ফলজ ও বনজ বৃক্ষরাজি, হাঁস-মুরগি, মৎস সম্পদের এক বিশাল সম্ভাবনার দিক উম্মোচিত হয়েছে চরাঞ্চলে। এ বছর সয়াবিন, বাদাম, তরমুজ, ভুট্টা ও কাচামরিচের চাষ হয়েছে ব্যাপকভাবে। এটি জীবন-জীবিকার উন্নয়নে একটি সুগম রাস্তা তৈরি করে দিবে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে এখানে ব্যাপকভাবে সবজির উৎপাদন হয়। কিন্তু সকল পণ্যের বাজারজাত করণের ক্ষেত্রে এখানে পরিবহন একটি বড় সমস্যা। এ উন্নয়ন সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখানে সুপরিসর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অন্য এখানে কৃষি সম্ভবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা। বেকার সমস্যা সমাধানে এ উদ্যোগগুলো ইতিবাচক অবদান রাখবে। এ অঞ্চলের শিল্প সম্ভবনাকে তত্বান্বিত করতে এখানে আরো কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে। এজন্য আগ্রহীদের মনোযোগ আর্কষণ করতে হবে। গবাদিপশু সম্পদ এখানকার বিশাল সম্ভবনা। নোয়াখালী চরাঞ্চলে রয়েছে প্রায় দুই লাখ একর খাসজমি। গবাদিপশুর জন্য এটি বিশাল গোচারণ ভুমি। নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলের বাজারগুলো গরুর দুধের লিটারপ্রতি মাত্র ১২ থেকে ১৪ টাকা। অথচ তার থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে দুধের লিটার প্রায় ৩০ টাকা। সঠিক বিপণন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকাতে প্রান্তিক উৎপাদকরা প্রতিদিন ঠকছে। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
নিঝুম দ্বীপ আরেকটি বিশাল সম্ভবনা। দেশের একমাত্র কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন এটি। এ বনে একদিকে রয়েছে প্রায় ১ লাখ হরিণের বসবাস অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের দারুন সুযোগ। ২০০১ সালের ৮ মে সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিঝুমদ্বীপকে জাতীয় উদ্যানের ঘোষনা দেন। কিন্তু তা ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পর্যটনের ক্ষেত্রে নিঝুম দ্বীপ অনেক বড় একটি ক্ষেত্র। কিন্তু এ সুযোগটি আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। যোগাযোগ ব্যবস্থা এ দ্বীপের সাথে প্রধান সমস্যা। একই সাথে পর্যটককে আর্কষণের জন্য এখানে কোনো স্থাপনা, আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। স্থানীয়দের মতে এ দ্বীপে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার পর্যটক আসে কিন্তু তাদের আবাসন, খাবার, যাতাযাত ইত্যাদি সমস্যায় পড়তে হয়। তাই এসকল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেতে হবে। সেই সাথে এখন নাগাদ নিধুম দ্বীপে জায়গা হস্তান্তর বা বেচাকেনা প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এ প্রক্রিয়াটি শুরু করেতে হবে। তাহলে নিঝুম দ্বীপের পর্যটন সম্ভবনাকে ঘিরে অনেক বেসরকারি উদ্যোক্তা এখানে বিনোযোগে আগ্রহী হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য গড়ে তোলা সবুজ বেষ্টনী উপকূলের মানুষের একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা। একে রক্ষা করা ও নতুন নতুন বনাঞ্চল সৃজনের মাধ্যমে এর স¤প্রসারণ জরুরি। বনাঞ্চলের কারণে জমির স্থায়িত্ব, উৎপাদনশীলতা, বনজ সম্পদ সৃষ্টি, জ্বালানী কাঠ, জীব বৈচিত্রের উন্নয়ন আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা করবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও ঝড় জলোচ্ছাস থেকে জনপদকে রক্ষা করবে। নিঝুম দ্বীপ একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। বনায়নের কারণে নিঝুম দ্বীপে একটি বিশেষ সম্ভাবনাময় অভয়ারণ্য সৃষ্টি হয়েছে। পশু, পাখির স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্র হয়েছে। শীতের পাখিরা নিয়ে আসছে আমাদের জন্য আনন্দ সংবাদ। আমাদের পরিবেশ হয়ে উঠছে সবার বাসের উপযোগী। নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ পর্যটন বিকাশে রাখতে পারে খুব ভালো ভুমিকা। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা আরো অনেক নতুন নতুন অভয়ারণ্য তৈরি করতে পারি। গড়তে পারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। রক্ষা করতে পারি জৈব বৈচিত্র এবং আমাদের বেঁেচ থাকার সুরক্ষা ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বয়ারচর আগামি সময়ের একটি বড় সম্ভবনার জায়গা। এ চরে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ টাকা কলা উৎপাদন হয়। প্রতিবছর শুধুমাত্র শিমের বিচি উৎপাদন হয় কমবেশি তিনশ মণ। কিন্তু এসবই চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এর প্রধান কারণ। বর্তমানে চর বসতি স্থাপন ও পুর্নবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার বয়ারচরে কাজ করছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের একটি পরিকল্পিত সভ্যতা তৈরিতে ভূমিকা রাখা জরুরি। বয়ারচরকে কেন্দ্র করে কমিয়ে আনা সম্ভব হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের যোগাযোগ দুরত্ব। বয়ারচরে পূর্ব ও দক্ষিণদিক গভীর মেঘনার পাশে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এখানে গড়ে তোলা সম্ভব একটি সমুদ্র বন্দর, যা নোয়াখালীর মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এখানে সমুদ্র বন্দর তৈরি হলে নোয়াখালীর শিল্প যোগাযোগ সমস্যার অনেকখানি সমাধান হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে যুবকদের একটি অংশ। তারা স্থানীয় সম্পদ ও বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলছে তাদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্র। নারীদের একটি বিশাল অংশ যুক্ত হয়েছে কুটির শিল্প সংশ্লিষ্ঠ কাজে। অনেকে হোগলা পাতা, বাঁশ-বেত, পাটিপাতা ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে তা দিয়ে ব্যবসা করেছে।
শেষ কথাআজকের পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক, দারিদ্র্যমুক্ত ও সামাজিক ন্যায্যতা অভিমূখীন লক্ষ্যে পৌছানোর নোয়াখালীর এ যাত্রাপথে প্রয়োজন ব্যাপক ঐকমত্য। আমাদের ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। একই সাথে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। জলাবদ্ধতা, ভূমিহীনতা, লবণাক্ততা, খাসজমি বন্টনে অব্যবস্থাপনা, অনুন্নত যোগাযোগ, অপরিকল্পিত জেলাশহর ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাহলে সম্ভবনার ক্ষেত্রেসমূহকে আমরা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারবো।

গণহীন গণমাধ্যম

একটি জটিল জায়গায় দাঁড়িয়ে হালের গণমাধ্যম নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। গণমাধ্যমগুলো যেভাবে ‘পাগলা ঘোড়া’ হয়ে সামনে দাবড়াচ্ছে তাতে এ ভাবনাগুলো আমলে রাখার দাবি অনেক বেশি যৌক্তিক। আজকের সময়ে আমজনতা অনেক বেশি সচেতন। কাছের অতীতেও মানুষ যেখানে ‘খবর’ নিয়ে তৃপ্ত থাকতো এখন সেখানে তারা গণমাধ্যম, তার চেহারা, তার ক্ষমতা, তার মেদ, মর্জি- মেজাজ, চালাকি-শঠতা নিয়ে কথা পাড়তে শুরু করেছে।যে কোনো সময়ের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে হালের গণমাধ্যম অনেক বেশি আগুয়ান। সুখের কথা গণমাধ্যমের অডিয়েন্সও সে তুলনায় খুব একটা পিছিয়ে নেই। গণমাধ্যমগুলো এ রূপ ধারণের সাথে সাথে তাদের সামাজিক কাজ-কর্মের জায়গাও সমানতালে সামলে নিচ্ছে, সামনে এগুচ্ছে।কিন্তু প্রশ্ন থাকছে কোন দিকে এগুচ্ছে, কার স্বার্থে এগুচ্ছে ? আমজনতার সেখানে প্রবেশাধিকার কতখানি?
এক.গণমাধ্যমগুলো আজকে মানুষকে সচেতন করা কিংবা শিক্ষিত করার যে দাবিগুলো তুলছে তা আলবৎ সত্য। আমাদের গ্রামগুলোতে এখন মেয়েরা আর কিছু না হোক চুল ধোয়ার জন্য ‘সানসিল্ক টুনিপ্যাক’, ত্বক ফর্সা করার জন্য ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী টুনিপ্যাক’ অথবা গোছলের জন্য কিংবা হালাল সাবান ব্যবহার করাতো করছে। এ সবইতো আমাদের টেলিভিশনগুলোর বদান্যতা। গণমাধ্যম থেকে শিখলো। টেলিভিশনগুলো তাদের মহান (!) দায়িত্ব পালন করছে বলেই মানুষ দু-চার শিখছে। সাবান ব্যবহার করলে তা হালাল হতে হবে তাও শিখছে। মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। এখানে তো সবই হালাল হতে হবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা সবই ফরফরে হালাল।কেউ কেউ অবশ্য এখন এ নিয়েও প্রশ্ন জাগান। যেমন গণমাধ্যমগুলো সাধারণ মানুষের ধর্মীয় মেজাজকে পুঁজি বানিয়ে বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিগুলোর স্বার্থ দেখছে কিনা ? কিংবা সচেতনভাবে এ শব্দগুলো ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সা¤প্রদায়িক মেজাজকে সচল করতে চায় কিনা ?এ সবই আসলে গণমাধ্যমের সচেতন কেরামতি। কে না জানে গণমাধ্যমের ক্ষমতা। তাই হয়তো সবাই একটু এ অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা, শক্তির আর্শিবাদ চায়। গণমাধ্যমও একটু একটু আর্শিবাদ দেয়। কিন্তু সবাইকে দেয় না। কেউ কেউ সে সুযোগ পায়। বিনিময়ে লেনদেন বাড়ে। হিসাব চলে ডলার, পাউন্ডে। আর এ লেনদেনের ছায়া পড়ে গরিবের ওপর। ভূমিহীন-গরিব চাষীর মেয়ে তখন চাল না কিনে চুল ধোয়ার জন্য ‘সানসিল্ক টুনিপ্যাক’ কিনে। এতে হয়ত গরিব-চাষী একবেলা না খেয়ে থাকে কিন্তু কোম্পানির মুনাফার অংক তো বাড়ে। এটাই তো আসল শিক্ষা ! বিজ্ঞাপন কিভাবে মানুষকে পণ্যমুখী করে তার প্রবিষ্ট উদাহরণ। এ তো গেল টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্য। এবার আসা যাক টেলিভিশনে অনুষ্ঠানগুলোর দিকে। কাদের জন্য অনুষ্ঠানগুলো বানানো হয় তাও জেনে রাখা ভালো। সবশেষে সংবাদে যাওয়া যাবে। এ জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের একদিনের অনুষ্ঠানসূচি নমুনা হিসেবে দেখা যেতে পারে। ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানসূচিতে ছিলো-সুপ্রভাত বাংলাদেশ, অর্কাইভস থেকে নির্বাচিত গান, ওশান গার্ল, সংবাদপত্রের পাতা থেকে, স্বাস্থ্য তথ্য, গডজিলা, সবার জন্য শিক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, সুখী পরিবার, আলোর ঝর্ণাধারা, সঙ্গীতা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, হাতের কাছে কম্পিউটার, ইতিহাস সংস্কৃতি উন্নতি, সন্ধামালতী, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অুনুষ্ঠান, শেয়ার বাজার, আবহাওয়া বার্তা, কুইজ কুইজ, থ্রি স্টুজেস, নাটক: সোনার হরিণ, নাটক: জাল, নাটক: জলে তাহার ছায়ায়, জীবন বাংলাদেশ মরণ বাংলাদেশ। এছাড়াও রয়েছে সংবাদ পাঁচবার, সংবাদ শিরোনাম পাঁচবার, সচিত্র সংবাদ একবার ও দেশ-জনপদের খবর একবার।দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ গ্রামের বসবাস করলে তাদের জন্য টেলিভিশনসূচিতে সেভাবে কোনো আয়োজন নেই। স্বাস্থ্য তথ্য, সবার জন্য শিক্ষা, সুখী পরিবার নামে খানতিনেক অনুষ্ঠানসূচিতে থাকলেও সেগুলো প্রচারের সময় ছিলো বেলা ১২টা থেকে ৩টার মধ্যে। কিন্তু প্রচেতণীমূলক এ অনুষ্ঠানগুলো যাদের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয় তারা বোধ হয় কেউই তখন টেলিভিশন সেটের সামনে থাকতে পারে না। হাজারো ইচ্ছা থাকলেও পারে না, কেননা সেই ভোর থেকে সাঁঝ নাগাদ তাকে মাঠেই পেটের তাগিদে মাঠে সময় দিতে হয়। সারাদিনের পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে গ্রামের কৃষক সন্ধায় গিয়ে বসে টেলিভিশনের সামনে। কিন্তু সেখানে তো মহাশঠতা। টেলিভিশনের পর্দায় নাটকের নামে যে আলোর রেখাগুলো ফুটে ওঠে তার সাথে গরিব কৃষকের জীবনের কোনো মিল নেই। মাটির গন্ধ নেই। প্রাণের টান নেই। টেলিভিশনে নাটক দেখানো হয় ঢাকার গুলশানে বসে নিউইর্য়াকে বার্গার বিক্রির স্বপ্নে বিভোর এক যুবকের। অথবা অট্টেলিয়ায় বিশ্ব সুন্দরি প্রতিযোগিতায় যাবে কোনো এক চৌধুরী বাড়ির ‘মিস তহুরা’ (আগে তাহেরা নাম ছিলো)। এমন সব আজগুবি আজগুবি জিনিস।ফলে সাধারণ মানুষ বিনোদনের জন্য শুধু ঢাকাইয়্যা আপা ভাইয়াদের রঙ্গিন রঙ্গিন কোত্তা-কাপড় দেখে সময় পার করে; কিন্তু না পারে বুঝতে, না পারে শিখতে। তবে কলিজার ভেতর ঢাকাইয়্যা আপা ভাইয়া সাজার জন্য খুব খুটসুট করে বৈইকি।গ্রামে ধানের জমিতে পোকার আক্রমণ, সবজিতে পোকার মড়ক, জোতদারের জমি দখল, যৌতুকের জন্য তালাক এমন বহু বিষয়ে তাদের জানা/শেখার দরকার থাকলেও তারা সে সুযোগ পায়না। অথচ রাষ্ট্রের টাকায় পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটি অবশ্যই দেশের বেশিরভাগ মানুষের স্বার্থে পরিচালিত হওয়া উচিত।টেলিভিশনের এ জাতীয় বিবেচনাহীন আজকে বিনোদন নিছক ‘বাজারী’ শব্দে পরিণত হয়েছে। বিনোদনের নামে সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের সম্পর্ক-যোগহীন, উচ্চবিলাসী চেতনার জন্ম দেয়া হচ্ছে। এসবের কারণে দেশের একমাত্র সরকারি টেলিভিশনটি আজো জনগণের টেলিভিশন হয়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য এর মাঝে বেসরকারি টেলিভিশনগুলো কিছুটা অন্তত ভূমিকা রাখতে পারছে। তবে সেখানেও অনুষ্ঠান তৈরি, অনুষ্ঠানের বিষয়, সম্পাদনা, প্রচার সময় অনেক বেশি উপরতলাবান্ধব, উচ্চবিলাসী।দুঃভাগ্য মানুষের, দুনিয়ার অনেক দেশে পাড়ায় পাড়ায় আলাদা টেলিভিশন থাকলেও আমাদের মোট-মাট চারটা চ্যানেল। তাও তিনটি স্যাটেলাইটে। স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুয়ের তা দেখার সুযোগ নেই। ডিশের সংযোগ লাগে। যাদের মোটে টেলিভিশন কেনার যোগার নেই তার ওপর আবার ডিশের সংযোগ! এটা তাদের জন্য প্রহসন কিনা কে জানে! তবু সরকার বাহাদুর বেসরকারি চ্যানেলকে টেরিস্টোরিয়াল অনুমোদন দেন না। সরকার আসে সরকার যায়, তবু বেসরকারি চ্যানেলকে টেরিস্টোরিয়াল অনুমোদন দেন না। এ দল না-ও দল খালি সে হিসাবে ব্যাস্ত। এতে লাভ কার হয় তা বোঝা না গেলেও ক্ষতি যে পাবলিকের হয় তা খুব বোঝা যায়। আবার অন্য কাহিনীও আছে। কারণ যাদের ডিশ আছে তারা ভুলেও বিটিভিতে যাননা। ‘ইদানিং হুমায়ুন আহমেদ কিংবা হানিফ সংকেত না থাকলে ডিশ মালিক বাঙালী দর্শক বিটিভির জন্য রিমোটের বোতাম টিপে না’।১সংবাদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সারাদিন ঘুরেফিরে সাদ্দাম-বুশ। কিন্তু গ্রামের মানুষের যে আরো কিছু খবর চাই সে দিকে নজর নাই। বাংলাদেশ টেলিভিশনে খবরের শুরু হয় খুনা-খুনি দিয়ে কিংবা বিরোধীদলকে বকাবকি করতে করতে। শেষ হয় মন্ত্রী মহোদয় ক্রিকেট তারকাকে পুরষ্কার তুলে দিচ্ছেন সে সংবাদ দিয়ে। মাঝখানে থাকে আগা-গোড়ার চর্বিত-চর্বণ, সরকারের তল্লিতপ্পার গুনগান। সাধারণ মানুষের যে আবো খবরা-খবর দরকার সেসব খবর যেন খবরই না। সেগুলো প্রজারের কোন আয়োজন নেই। আশার কথা এজন্য অবশ্য আমাদের উর্বর মস্তিস্কজীবী টেলিভিশন কর্তাদের ভাবনার উদ্বেগ হয়েছে। তাই হয়তো সন্ধে ছয়টায় দেশ-জনপদের খবর প্রচার করেন। অবশ্য সংবাদের টাইটেল দেখে বোঝা যায়, এটাই শুধু দেশের খবর। বাকিগুলো দেশ-মানুষের খবর না। সেগুলো গদিওয়ালাদের, কোম্পানিদের খবর। তারা তো মানুষ না মহামানুষ।তবু গরিব মানুষগুলোর শুকরিয়া যে নামেই হোক তাদের জন্য কিঞ্চিত আয়োজন দেখে। যদিও ৬৪ জেলার খবর প্রচারের জন্য সময় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র পাঁচ মিনিট।‘বিটিভির সংবাদকে সাধারণত বলা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালার প্রমাণ্য প্রতীক’।২ এছাড়া ‘সংবাদ-মূল্যহীন স্টেরিওটাইপে ট্রিটমেন্টের কারণে বিটিভির সংবাদের কতটুকু অংশজুড়ে কী কী ধরণের সংবাদ ও দৃশ্যাত পরিবেশিত হবে তা বিটিভির অনিয়মিত দর্শক-শ্রোতারাও খুব ভালো করে বলে দিতে পারেন অনায়াসে।’৩
দুই.গণমাধ্যমের মহান কর্তব্যে নিজেদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করার জন্য এখন গণমাধ্যমকে ‘গ্র“প অব কোম্পানি’র অংশ বানিয়ে নিচ্ছে। বাজারের কারণে পুঁজি যত বেশি কেন্দ্রিভূত হচ্ছে তত বেশি পুঁজি বাড়াতে ও তাকে শিকল পরাতে ফন্দি-ফিকির বের করা হচ্ছে। হোক মুদ্রণ মাধ্যম অথবা বিদ্যুতান মাধ্যম সবই এখন বাজার, পুঁজি, মুনাফা, শেয়ার, ফাড়িয়ার মত শব্দগুলোর পাশে ব্যবহার হচ্ছে। সময়ের যে পাগলা ঘোড়ায় আমরা চড়ে বসেছি সেখানে গণমাধ্যমের এ অবস্থা বাচ-বিচারের সময়ও বোধ হয় এখন আর খুব একটা নেই। কর্পোরেট হাউজ, বহুজাতিক কোম্পানির দেশীয় সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক,উৎপাদক, জমি ব্যবসায়ী এখন সবাই পত্রিকার মালিক বনে যাবার জোর হিড়িক পড়েছে। খারাপ কি পত্রিকায় পত্রিকা বেরুবে। সে পত্রিকায় দু কলাম দু ইঞ্চিতে ডেঙ্গু মশার খবর বেরুবে, সাথে ছয় কলাম আট ইঞ্চিতে বেরুবে সে কোম্পানির মশার কয়েলের বিজ্ঞাপন। নিশ্চয়ই এটি একটি মহতী উদ্যোগ। সাদাসিধা মানুষকে শিক্ষিত(!) করার আর কি কোনো ভালো পদ্ধতি থাকতে পারে? কিন্তু পত্রিকার এ জাতীয় মালিকানা, অংশীদারিত্ব, প্রণোদনা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতায় কী ভূমিকা রাখছে তা ভাবনার সময় এসেছে। এ জাতীয় পত্রিকার মালিকরা আসলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখে কিনা, আসল খবর প্রকাশ করতে পারে কিনা তা কমবেশি উদ্বেগের জন্ম দেয়। সমাজসেবা, দেশসেবা কিংবা সাধারণ মানুষের কল্যাণে দুপাতা-চারপাতা বের করা আর আমদানিকারকের প্রণোদনায় প্রকাশ পাওয়া পত্রিকার আদর্শ লক্ষ্য যে এক নয় তা সহজে অনুমেয়। কেননা এ জাতীয় মালিকের নিয়ন্ত্রণ অলিখিতভাবেই সংবাদ প্রকাশের ওপর এক ধরণের বিধি-নিষেধ তৈরি করে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো এ ক্ষেত্রে কর্পোরেট মিডিয়ার উদাহরন টানেন। ইতিউতি দিয়ে দুনিয়াবি কথা বলেন। বিশ্বায়ন বুঝান।তবু আমাদের দমে যাবার কিছূ নেই। এ চাতুরিপনার মাঝেও আমাদের একটু আশার জায়গা আছে। তা অনস্বীকার্যভাবে আমাদের স্থানীয় সংবাদপত্র। ব্যবসা-বাণিজ্যের এ সময়ে স্থানীয় সংবাদপত্রই হতে পারে সমাজ, সংস্কৃতি আর গণমানুষের বাতিঘর।
তিন.২০০৩ সালের এমএসসি পরীক্ষায় দেশের বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ফলাফল খারাপ হয়েছিল। অ+ পাওয়া ছাত্র ছিলো হাতেগোনা। নোয়াখালীতে ভালো ফলাফলের সৌভাগ্য হয়েছিল হাতিয়ার একটি ছেলের। এলাকাবাসী, পরিবার এমন কি জেলার মানুষেরও আশা ছিল এ খবরটি পত্রিকায় আসবে। কিন্তু আসেনি। প্রতিদিন এ রকম হাজার ঘটনা খবর হয়ে গণমাধ্যমে আসুক আসুক করে গ্রামদেশের মানুষ। কিন্তু আসে না। মূলধারার যে সাংবাদিকতা সেখানে এসব খবর অনেকটাই আড়ালে-আবডালে থেকে যায়। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে কিংবা মফস্বল পাতা নামক অন্দর মহলে মাঝে মাঝে যে দু একটা সংবাদ হাতড়ে পাওয়া যায় তাও নিতান্ত লজ্জাজনক। কিন্তু এ প্রান্তিক মানুষগুলোরও যে দর্শন থাকতে পারে, বিশ্বাস থাকতে পারে, মূল্যবোধ থাকতে পারে, অর্থনীতি, সমাজনীতি কিংবা নিজস্ব একটা বেঁচে থাকা থাকতে পারে তা বরাবরই উপেক্ষিত।কিন্তু এ প্রান্তিকতা ফেলনা নয়, এ বিশ্বাসগুলো অবজ্ঞার নয়- এ ধারণাগুলো ওঠে আসা দরকার জাতির চোখের সামনে। এ বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় এক একটি স্থানীয় সংবাদপত্র।আজকের বিশ্বগ্রামের প্রেক্ষিতের জাতীয় কিংবা স্থানীয় বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু রাজধানী কেন্দ্রিকতা, বেশি সার্কুলেশন আর পুঁজির কেন্দ্রমুখীতার কারণে কিছু কিছু পত্রিকা জাতীয় পত্রিকার জুব্বা পরলেও আসলে তা ফায়েদা লুটার খোলস মাত্র। তাই যাই হোক আর কোনো সমর্থক শব্দ থাক না থাক স্থানীয় পত্রিকা শব্দটি অনেক বেশি অহংকার বোধের উচ্চারণ। একটি দ্বাম্বিক অবস্থার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় একটি একটি স্থানীয় সংবাদপত্র। একদিকে তাদের পাঠক দায়বদ্ধতা । অন্যদিকে তাদের আর্থিক অসংগতি। এ দুয়ের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে অনেক পত্রিকা তাদের আদর্শের লড়াইয়ে শেষ নাগাদ টিকতে পারে না। কোনো কোনোটির অকাল মৃত্যু হয়। আবার কোনো কোনোটি খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেঁচে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন, মানবাধিকার, প্রতিষ্ঠায় অবশ্যই স্থানীয় পত্রিকার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির যেমন এ শিল্পের সহায়তায় কোনো আগ্রহ নেই তেমন সরকারের কাছেও নেই। পত্রিকাকে বাঁচানোর জন্য সরকারি বিজ্ঞাপন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক। অথচ সরকারি বিজ্ঞাপন বিতরণ হয় সরকার ও তার সমর্থিত দল, প্রশাসনকে তোয়াজ তোষণের মাপকাঠিতে। এতে করে সরকারি বিজ্ঞাপনকে পত্রিকার সহায়ক নয় বরং হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন বন্টনে রয়েছে ম্যালা ধরনের আইনী মারপ্যাচ। এতে করে স্থানীয় বেশিরভাগ পত্রিকাই বিজ্ঞাপন পায় না। দুএকটি পত্রিকা বিজ্ঞাপন পেলেও যত টাকা বিজ্ঞাপনের দাম তার অর্ধেক কর্মকর্তাদের নাজরানা দিতে হয়।সংবাদপত্র হচ্ছে একটি সমাজের দর্পন। গ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে দেখতে হলে গ্রাম দেখতে হবে। গ্রামের সংবাদপত্রগুলোকে দেখতে হবে। এ জন্য গ্রামের সংবাদপত্রের আরো বেশি প্রণোদনা দরকার। জরুরিভিত্তিতে দরকার সরকারি বিজ্ঞাপন বন্টন নীতিমালা (হাতিয়ার) সংস্কার। এছাড়াও স্থানীয় পত্রিকাগুলোকে প্রাত্যহিক প্রযুক্তিগত বাধা, প্রশাসনিক প্রতিকূলতা, সংবাদকর্মীদের অদক্ষতা, রাজনৈতিক হুমকিসহ ইত্যকার বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হয়।এসবের পরে স্থানীয় পত্রিকাগুলো বেরুচ্ছে। এখন শুধু দরকার এগুলোকে আরো জনমুখী করে তোলা। সেজন্য সরকার, বেসরকারি সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং ব্যক্তিক অংশগ্রহন নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।

Wednesday, July 11, 2007

পুলিশী রাষ্ট্রে আমাদের বসবাস

- আপনার বাসা এইটা ?- হাঁ- এই, এইটা রে গাড়িতে তোল।- মানে ?- মানে কী, মারামারিতে তুমিও ছিলা, এখন জামাকাপড় বদল কইরা আসছ।
এটা কথা বলে আমার হাত ধরে টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে যায় দুুজন দায়িত্ববান (!) সাবইন্সপেক্টার। আমি বললাম, আমি ভাই কিছু জানি না। আমাকে নিয়ে টানাটানি করেন কেন? কে শোনে কার কথা। পাশ থেকে একজন বললো, উনি সাংবাদিক। এতে করে সাবইন্সপেক্টার দ্বয় সামান্য থামেন। তারপর বললেন কিসের সাংবাদিক(!!!) ?
হঠাৎ কি হলো কে জানে। এক সাবইন্সপেক্টার বললো, গাড়িতে তোলার দরকার নেই, তুমি আমার সাাথে আস। আমি তার সাথে গেলাম। তিনি আমাকে আলাদা নিয়ে জেরা শুরু করলেন। আমার হাতের বাহু ধরে নিয়ে আসার সময় যে কর্মকর্তা বলেছিলেন, মারামারিতে তুমিও ছিলা, এখন জামাকাপড় বদল করে আসছ। তিনি আমাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন, ঘটনার সময় কোথায় ছিলা। কি বিচিত্র!! যিনি একটা আগে দেখেছেন আমি মারামারি করে আবার জামাকাপড় বদল করে এসেছি, তিনি আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন ঘটনার সময় আমি কোথায় ছিলাম। কিন্তু বিচক্ষণতা!!!
এটা ২২ অক্টোবরের ঘটনা। আবাসিক এলাকায় একটা রাজনৈতিক দলের দুুটো গ্র“পে মধ্যে মারামারি লেগেছে। আমার বাসা এবং অফিস এখানেই। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি একদলের বেশ সাজসাজ ভাব। একটু সামনে আসতেই বোমা ফাটার শব্দ পেলাম, চার পাঁচটা। আমি ভাবলাম কি হতে কী হয়, আবাসিক এলাকা। তাছাড়া আমার বাসার কাছেই প্রায়। আমি আমার এক অগ্রজ সাংবাদিককে ফোন করলাম। তারপর আর কী করা, আমি ভাবলাম শেষ ভরসা পুলিশকে বিষয়টা জানাই। সুধারাম থানায় ঢুকতেই দেখলাম এক সাবইন্সপেক্টার দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি। এর আগে এসপি অফিসে ছিলেন। শুনেছি এরপর প্রমোশন নিয়ে এসআই হয়ে সুধারাম থানায় বদলি। আমি তাকে বিষয়টা বললাম। তিনিও বোধহয় তখন বেরুবেন। তিনি বললেন একটু ওসি স্যারকে বিষয়টা বলেন। তার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল তিনি বোধ হয় আসতে চাচ্ছেন না। অথবা আসতে ভয় পাচ্ছেন। যত কিছু হোক মারামারির ভেতরে কে আসে। জীবনের ভয় তো আছেই। আমার কথা শেষ করে আমি আবার বাসার দিকে রওনা হলাম।
আমার বাসার সাথে বেসরকারি সংস্থা এনআরডিএসের অফিস। সেখানে কতসময় থেকে আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। কতক্ষণ বাদেই শুরু হলো আমাকে নিয়ে এ ঘটনা। মজার কাহিনী হলো, আবার যে দুজন কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তাদের মধ্যে একজনকেই আমি থানায় গিয়ে মারামারির খবরটা দিয়েছিলাম। মারামারিতে আমিও ছিলাম বলে যে স্বপ্নপ্র্প্ত কাহিনী উপস্থাপন হচ্ছিল তখনও তিনি নির্বিকার দাঁড়িয়ে।
এ হচ্ছে আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থা। আমি জানি না কেন সে দিন আমাকে ধরে নিয়ে তাৎক্ষণিক জেরা করলো। ঘটনা শেষে কয়জনকে আটক করতে হবে, এ জন্য? নাকি আমাকে চিনতে পারেনি ? আমার মনে হয় চিনতে পারেনি। কারণ শ্রদ্ধাভাজনেষু এসআই মহোদয় যখন আমার সাথে জেরা শেষ করলেন তখন আরেকজনকে বলছিলেন, কি কর মিয়া লোকজন চিন না। যদি আসলেই আমাকে না চিনে থাকেন তাহলে আরো কিছু প্রশ্নবোধক তৈরি হয়। তাহলে কি পুলিশ প্রায় এ রকম মানুষ চিনতে ভুল করেন। অনেক মানুষকেই কি এ রকম ভুলের প্রায়শ্চিত্য দিতে হয়? মজার ব্যাপার হলো আমার বাসার সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দায়িত্ববান (!) সাবইন্সপেক্টার মহোদয় একটি অভিজ্ঞ ও চমকপ্রদ তথ্য দিলেন, আমি নাকি মারামারি করে আবার জামাকাপড় বদল করে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি। অবশ্য আমি বলার পর আমার কাছ থেকে তথ্যগ্রহণকারী কর্মকর্তা আমাকে চিনতে পেরেছিলেন।
পুলিশকে বলা হয় জনগণের বন্ধু। কিন্তু যে কয়বার আমার সাথে তাদের কর্মযোগাযোগ হয়েছে আমি তাদের মধ্যে একবারও এ জাতীয় বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ দেখিনি। প্রথমত আমি একজন মানুষ, তারপরও আমার আরো পরিচয় থাকতে পারে। আর সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি এ দেশের নাগরিক। যে নাগরিকের জন্য পুলিশ, বন্ধুক(!) ইত্যাদি। আমাকে যখন ঐ কর্মকর্তা জেরা করছেন তিনি আমাকে সম্বোধন করছেন ‘তুই’ বলে। আমি জানি না ক্রিমিনালজি থিউরিতে মানুষকে সম্মান না করে কথা বলার কথা লেখা আছে কিনা।
দিন তিনেক আগে কোম্পানিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ০৫ জন ব্যবসায়ী মারা গেছ্।ে ঐ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন ঐদিন কোম্পানিগঞ্জে গুলি করে মানুষ মারার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমাকে যকন জেরা করছিল তখন আরেক পুলিশ কর্মকর্তা দাড়িয়ে থাকা মানুষদের উদ্দেশ্য করে বেশ দম্ভ নিয়ে বলছে, আপনারা সব সরেন, কোম্পানিগঞ্জে যে পাঁচটা সাইজ হইছে মনে নাই ?
আসলে আমরা কোথায় থাকবো? রাষ্ট্র্র থেকে মদদ নিয়ে চলছে বিকল্প অমর্যাদাকর কর্মকান্ড। অন্য সন্ত্রাসীদের সাথে এ সন্ত্রাসের পার্থক্য হচ্ছে, অন্য সন্ত্রাসীরা সমাজে কিছু কিছু মানুষকে সম্মান করে, সমাজের আচরণ মূল্যবোধ সমূহ মেনে চলে আর এরা তা করেন না। অন্যরা সমাজের মানুষকে সম্মান করে বা দেখায় আর এরা তার উল্টোটা করেন। অন্যরা সবার সাথে অমর্যাদাকর আচরণ করেন না আর এনারা...............................................?
একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনী ছাড়া আর কারো কাছে অস্ত্র থাকা দরকার বলেও আমি মনে করি না। কিন্তু আমার দুঃভাগ্য আমাদের অন্যান্য বাহিনীর হাতে শুধু অস্ত্র না রীতিমতো এখন যুদ্ধ অস্ত্র শোভা পায়। অবশ্য এরও একটা ব্যাখ্যা থাকতে পারে। সন্ত্রাসীদের কাছে বড় বড় অস্ত্র আছে বিধায় পুলিশকেও তা রাখতে হয়। কিন্তু প্রশ্নটি যদি উল্টো হয়? পুলিশ বাহিনীর হাতে এসব নজরকাড়া (!) চকচকে অস্ত্র দেখেই অন্যরা এমনতর অস্ত্র জোগাড়ে অভ্যস্ত হয়।
যাই হোক, যার কাছে যত দারুন অস্ত্র থাক না কেন আমার কোনো আপত্তি আর নেই। আমার শুধু একটাই ভয় এত ভারী ভারী অস্ত্রের ট্রিগারের সামনে বসবাস করে আমরা সাধারণ মানুষ কতদিন বাঁচতে পারবো এ স্বাধীন দেশে ? আমাদের টেনশন কী কখনোই কাটবে না ? নাকি আমজনতাকে টেনশনে রাখাই পুঁজিতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূল খেলা ?